বাংলাদেশে অসংখ্য ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প রয়েছে যারা অসংখ্য ভিন্নধর্মী পণ্য নিয়ে কাজ করে। আর এসব শিল্পকে নিয়ে কাজ করে ইসিবি।

মৌলভিবাজারের আলীনগর উপজেলার একটি গ্রামের বাসিন্দা মরিয়ম। ২০১৪ সালে একদল গুণ্ডা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরদিন সকালে মরিয়মকে অজ্ঞান অবস্থায় তার বাড়ির পাশে পড়ে থাকতে দেখে এলাকাবাসী। অপহরণকারীদের অমানবিক শারীরিক নির্যাতনের পরেও বেঁচে থাকেন মরিয়ম। তবে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। অবস্থা এতোটা খারাপদিকে মোড় নেয় যে এলাকাবাসী তাকে গাছের সাথে বেঁধে রাখে। এমন অবস্থাতেই মরিয়মের সাথে দেখা হয় “ইসিবি” নামক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদেরকে নিয়ে কাজ করা একটি প্রকল্পের প্রতিনিধি দলের।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে কাজ করে ইসিবি। প্রকল্পটির প্রতিষ্ঠাতা মোশাররফ হোসেন বলেন, “আমরা মূলত গ্রামীণ নারীদেরকে নিয়ে কাজ করি। আমাদের উদ্দেশ্য বেকারত্ব, যৌতুক, বৈষম্য এবং পারিবারিক নির্যাতনের মতন সামাজিক সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে পারে এমন একটি বিজনেস মডেল তৈরি করা। এই বিজনেস মডেলটিকে আমরা নারীদের ক্ষমতায়নে ব্যবহার করতে চাই।”
ইসিবির বিজনেস মডেলটি বেশ জটিল হলেও তাদের মূল উদ্দেশ্য বেশ সহজ। সমাজের অবহেলিত এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোটাই ইসিবির মূল লক্ষ্য। ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করে ইতোমধ্যে দেশের ১৩টি জেলায় নিজেদের কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে প্রকল্পটি। চার বছরে দেশে প্রায় আড়াইশো নারী উদ্যোক্তার জন্ম হয়েছে এই প্রকল্পের হাত ধরে। বাংলাদেশের সীমানা বেড়িয়ে ইতোমধ্যে ভারতের বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যেও নিজেদের কার্যক্রম ছড়িয়ে দিয়েছে ইসিবি।
ছবি: ইসিবির অফিসে সাজানো বিভিন্ন পণ্য।
ফিরে যাওয়া যাক মরিয়মের ঘটনায়। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মরিয়মকে পেয়ে ইসিবির প্রতিনিধিদল প্রথমেই তাকে সিলেটের ওসমানি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তার চিকিৎসা নিশ্চিত করে তাকে একটি সেলাই মেশিন কিনে দেওয়া হয়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মরিয়ম আজ একজন সফল উদ্যোক্তা। মরিয়মের জীবনের সেই ঘটনাকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে একটি স্বল্পদৈঘ্যের প্রামান্যচিত্র। যেটি পুরষ্কার জিতেছে ব্রুকলিন এবং সিকাগোর আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভেলে।
গ্রামের নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে ইসিবি। তবে প্রশিক্ষণের ধরণটা কিছুটা ভিন্ন। এ প্রসঙ্গে মোশাররফ হোসেন বলেন, “শহরের মানুষজন যেসকল সুযোগ সুবিধা পায়, গ্রামে সেরকম সুযোগ সুবিধা থাকে না। তাদের অনেক কিছু বুঝতে একটু বেশি সময় লাগে। তিনি আরও বলেন, “প্রতিটি প্রশিক্ষণের আগে আমরা সাতদিন সময় নেই। এই সাতদিনে আমরা সেখানকার মানুষজন কী চায় সেটা বোঝার চেষ্টা করি এবং সেই অনুযায়ী আমাদের প্রশিক্ষণের ধরণটা নির্ধারণ করি।” প্রশিক্ষণের আগে সাত দিনের এই কার্যক্রমই ইসিবির প্রশিক্ষণগুলিকে অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণের চেয়ে আলাদা করে দেয় বলে মনে করেন তিনি।
কার্যক্রম চলা এলাকাগুলিতে বিভিন্ন প্রকারের পর্ণ এবং সেবাভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে ইসিবি। পাটজাত পণ্যের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শীতল পাটি তৈরি, কাদামাটির জিনিসপত্র তৈরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় উদ্যোক্তাদেরকে। পাশাপাশি প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহারের প্রশিক্ষণও প্রদান করা হয়। ইসিবির কাছ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্যোক্তারা মুঠোফোনে ইমো ব্যবহার করে ভিডিও কল দিতে পারে, একজন আরেকজনকে বার্তা পাঠাতে পারে। একজন সফল ব্যবসায়ী হতে হলে যোগাযোগে দক্ষতা থাকাটাকেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন মোশাররফ হোসেন।
ছবি: ইমো ভিডিও কলে মোশাররফ হোসেনের সাথে কথা বলছেন মরিয়ম।
কেবলমাত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি করেই ইসিবির কার্যক্রম শেষ হয়ে যায় না। প্রশিক্ষণ শেষে উদ্যোক্তারা পণ্য তৈরি করা শুরু করলে সেগুলো “ইসিবি এন্টারপ্রাইজ”-এর মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। শ্যামলীর বাবর রোডে অবস্থিত ইসিবির ছোট্টো অফিসে গিয়ে দেখা যায়, অফিসে সাজানো হরেক রকমের পণ্য। ইসিবি এন্টারপ্রাইজের সেলস সেন্টারে কর্মরত রূপালি খাতুন বলেন, “দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্নরকমের পণ্য পাই আমরা। টাঙ্গাইল থেকে আসে আনারস, নওগা থেকে আম, বরিশাল থেকে শীতলপাটি আর রংপুর থেকে হাতে বানানো বিভিন্ন জিনিসপত্র।” তবে পাটজাত পণ্য সবচেয়ে বেশি আসে বলে জানান তিনি। পাটজাত বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে আছে চাবির রিং, কলম দানি এবং হরেক রকমের ব্যাগ।
[[লেখা সম্পর্কিত আপনার যেকোনো মতামত আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারেন নিচের মন্তব্য বক্সে বা ভেরিফাইড প্রেসের ফেসবুক পাতায়।]]
Leave a Reply