যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান রাখা, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন রেখে সড়ক আইন সংশোধন এবং প্রতিহিংসা সরিয়ে জাতীয় ঐক্য তৈরির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে ঐক্যফ্রন্ট।

একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে ডক্টর কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ইশতেহারে রয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান রাখার পাশাপাশি দুই মেয়াদের বেশি একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকতে না পারা এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকৃত শিক্ষার্থীদের নয় দফা দাবির সবগুলি মেনে নেবার প্রতিশ্রুতি। ভেরিফাইড প্রেসের পাঠকদের জন্যে ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো একে একে তুলে ধরা হলো।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন
কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকৃতদের বিরুদ্ধে করা সকল মামলা প্রত্যাহার
পাশাপাশি কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের বিপরীতে থাকা সকল ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার করবে ঐক্যফ্রন্ট। শুধু তাই নয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সৃষ্ট মামলাগুলি প্রত্যাহার করবে তারা। দুই ক্ষেত্রেই মামলা প্রত্যাহারের পাশাপাশি ক্ষতিপূরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করে তাদের দাবিকৃত নয় দফা দাবি অনুযায়ী সড়ক আইন সংশোধন করা হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম চলমান থাকবে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের “সত্যিকার চেতনা” নিয়ে মানুষকে সচেতন করে তোলা হবে। সঠিক তালিকা তৈরির মাধ্যমে বাদ দেওয়া হবে “ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা”দের। বৃদ্ধি করা হবে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা।
কল রেট এবং ইন্টারনেট খরচ কমানো
মোবাইলের কল রেট এবং ইন্টারনেট খরচ কমানো হবে। দেশের সকল প্রান্তে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি নিশ্চিত করতে অপারেটরদের বাধ্য করা হবে। বিভিন্ন গণজমায়েত এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বিনামূল্যে ওয়াইফাইয়ের ব্যবস্থা করা হবে। ভূমি রেকর্ডকে পুরোপুরি ডিজিটাল করা হবে। স্থাপন করা হবে আরও আইটি পার্ক। ই-গভর্নেন্সের ব্যপ্তি বাড়ানো হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, ন্যানো টেকনোলজির জন্যে পর্যাপ্ত অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে এবং সঠিক কক্ষপথে নতুন স্যাটেলাইট প্রেরণ করা হবে।
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে কাজ করবে ঐক্যফ্রন্ট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে সকলপ্রকারের সরকারী বিধি নিষেধ সরিয়ে জনগণকে মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হবে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি সরকারকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের অধিকারও জনগণের থাকবে। এসকল ক্ষেত্রে কেউ ক্ষুব্ধ হলে নিজ দায়িত্বে মানহানির মামলা করতে হবে এবং এই মামলাগুলি কোনোক্রমেই ফৌজদারি মামলা বলে বিবেচিত হবে না।
নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার
নির্বাচনকালীন সরকারের বিধান তৈরি করে নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা প্রদান করে জনগণের ভোটের অধিকার শতভাগ রক্ষা করার জন্য কাজ করবে ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন বাজেট থাকবে এবং এটি পুরোপুরি সরকারের প্রভাবমুক্ত থাকবে। পর পর দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকতে পারবেন না।
প্রতিহিংসা বা জিঘাংসা সরিয়ে জাতীয় ঐক্য তৈরির প্রতিশ্রুতি
বিগত দশ বছরে স্বেচ্ছাচারিতা এবং পুলিশকে দলীয় ক্যাডার হিসেবে ব্যবহার করে হাজার হাজার মামলা, হত্যা এবং গুম করা হয়েছে বলে দাবি করছে ঐক্যফ্রন্ট। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তারা এসব ঘটনার সুষ্ঠু সমাধান খোঁজার জন্যে শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী, আইনজীবিদেরকে নিয়ে বিশেষ কমিশন গঠনের ব্যাপারে বলেছে। “ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসাইল” নামে এই কমিশন হয়রানীমূলক মামলাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করবে। ক্ষমা এবং ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে সমাধানগুলি করা হবে বলে জানানো হয়েছে নির্বাচনী ইশতেহারে।
ভ্যাটমুক্ত বেসরকারী শিক্ষা এবং নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন
শুরুর বছর থেকেই ডাকসু সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা হবে। সম্পূর্ণরূপে ভ্যাটের আওতামুক্ত থাকবে বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি।
বর্তমান সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প
বর্তমান সরকারের কোনোপ্রকার উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করা হবে না। শেষ দুই বছরে তড়িঘড়ি করে চালু করা প্রকল্পগুলিকে পুনর্বিবেচনা করার জন্য কমিটি গঠন করা হবে। চালু থাকা প্রকল্পগুলোর ব্যয় নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ভাল অর্থনৈতিক উপযোগিতা ব্যতিত বৈদেশিক ঋণ নির্ভর কোনো প্রকল্প গৃহীত হবে না।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
“সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও কারো সাথে বৈরতা নয়” নীতির মাধ্যমে সবার সাথে ভালো সম্পর্ক রক্ষা করা হবে। সার্কসহ অন্যান্য আঞ্চলিক জোটগুলিকে আরো শক্তিশালী করার পাশাপাশি ভারতের সাথে আরো ভালো সম্পর্ক তৈরির জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তিস্তাসহ অন্যান্য নদীর পানিবণ্টন জনিত সমস্যাগুলো সমাধান করা হবে। আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা হবে।
কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা
তরুণদের কর্মসংস্থানকে সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকারের একটি হিসেবে বিবেচনা করে বেকারত্ব কমানোর জন্যে প্র্রয়োজনীয় কাজ করা হবে। পুলিশ এবং সামরিক বাহিনী ছাড়া অন্য কোনো সরকারি চাকরিতে যোগদানের কোনো বয়স সীমা থাকবে না। প্রতিবন্ধী এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ব্যতিত সকল প্রকারের কোটা তুলে দেওয়া হবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সব সরকারি মূন্য পদে নিয়োগ সম্পন্ন করা হবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্লাটফর্ম “বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ”-এর প্রকাশিত “তারুণের ইশতেহার ভাবনা – ২০১৮” থেকে বেশ কিছু অংশ নেওয়া হয়েছে ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে। বড় বড় নিয়োগ পরীক্ষাগুলো বিভাগীয় শহরগুলোতে নেবার ব্যবস্থা করা হবে। সকল নিয়োগ পরীক্ষা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আলাদা বোর্ড গঠন করা হবে। দেশে ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া অবৈধভাবে কাজ করা সকল বিদেশী নাগরিকের চাকরি বন্ধ করা হবে।
উদ্যোক্তা তরুণদের জন্য কম সুদে ঋণ প্রদান করা হবে। কৃষি উৎপাদন এবং কৃষি বিপননে কর্মসংস্থান তৈরি হবে স্মাতক ডিগ্রী পর্যন্ত যেতে না পারা তরুণদের। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে উৎসাহিত করা হবে যাতে আরও বেশি সংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়।
সরকারী এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়
গরীব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসন সংরক্ষণ করা হবে। বাতিল করা হবে পিএসসি এবং জেএসসি পরীক্ষা। তারুণ্যের ইশতেহার ভাবনা ২০১৮ থেকে নেওয়া হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোকে ক্যাটাগরি অনুযায়ী ভাগ করে সরকারিভাবে শিক্ষাব্যয় নির্দিষ্ট করে ফি নির্ধারণ করার ব্যাপারটি। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সমস্যার সমাধান করতেও কাজ করবে ঐক্যফ্রন্ট। ছাত্র রাজনীতির নামে আবাসিক হলের সিট বাণিজ্য এবং জোর করে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ ও শিক্ষার্থীদের হয়রানি বন্ধের উদ্দেশ্যে হলের সিট বরাদ্দকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে হল প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে দেওয়া হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে খাবারের মান বাড়ানো এবং মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে নির্বাচনী ইশতেহারে।
শিক্ষা নিয়ে রয়েছে আরও অনেকগুলি প্রতিশ্রুতি। যার মধ্যে আছে; “প্রশ্ন ফাঁস বিরোধী সেল” গঠন, বেসরকারি স্কুলগুলোকে ধীরে ধীরে জাতীয়করণ করা, প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য ক্যাডার সার্ভিস চালু, কর্মমুখী শিক্ষায় আগ্রহীদের বৃত্তি প্রদান, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কারিগরী শিক্ষা দিয়ে বিদেশে পাঠানো এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য শিক্ষক নিয়োগ।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিক হত্যার বিচার
স্বাধীন প্রেস কাউন্সিলের অধীনে সকল প্রকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। নিয়মিত করা হবে সাংবাদিকদের মজুরি বোর্ড। সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমকে উৎসাহিত করা হবে। প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক সাংবাদিকদের জন্য নতুন প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট স্থাপন করা হবে এবং সংবাদপত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হবে।
সাগর-রুনিসহ সকল সাংবাদিক হত্যার বিচার এবং সাম্প্রতিক নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ সকল ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকদের নিগ্রহের বিচার হবে। পাশাপাশি, ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের শতভাগ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করা হবে।
প্রকৃতি ও পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন
বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়া দেশগুলির মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। তাই জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবেলায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে কাজ করে যাবে সরকার। প্রাকৃতিক বন রক্ষায় সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং পরিবেশ দূষণকারী কোনো শিল্প কারখানা চলতে দেয়া হবে না। সকল কারখানায় এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্টের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে। ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ছাড়া কোনো কারখানায় কাজ করতে দেওয়া হবে না। নয়ানযোগ্য জ্বালানিতে জোর দিয়ে বাতাসে বিষাক্ত গ্যাসের নিঃসরণ কমানো হবে এবং শহরে গাড়ির হর্ন এবং তীব্র শব্দের ফলে সৃষ্ট শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শহরের বজ্য ব্যবস্থাপনাকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে নতুন করে সাজানো হবে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আগে অনেক কাজ করা হলেও গত দশ বছরে এটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে মনে করছে ঐক্যফ্রন্ট। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে আবারও গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হবে।
এছাড়াও ইশতেহারে রয়েছে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে উন্নয়ন, দুর্নীতি দমন, খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ, মাদক নিয়ন্ত্রণ, প্রবাসীদের কল্যাণ, আদালত, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, জাতীয় অর্থনীতি, শিল্প ও কৃষকদের জীবন মান উন্নয়ন করা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিশ্রুতি।
[[লেখা সম্পর্কিত আপনার যেকোনো মতামত আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারেন নিচের মন্তব্য বক্সে বা ভেরিফাইড প্রেসের ফেসবুক পাতায়।]]
Leave a Reply