
লেখাটি কী কিডনি রোগ নিয়ে, না চিকিৎসা ব্যবস্থার রোগ নিয়ে- কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেছি। মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে, একটা গল্প বলি। গল্পটি যার তিনি এখন নানা কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনায় আসেন। মাহাথীর মোহাম্মদের কথা বলছি। যিনি খুব সাধারণ মালয়েশিয়াকে সমৃদ্ধ-উন্নত মালয়েশিয়াতে পরিণত করেছেন। প্রচলিত ‘ঋণভিত্তিক উন্নয়ন’র পথে তিনি হাঁটেননি। হেঁটেছেন তার নিজস্ব পদ্ধতিতে। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার কথা মুখে কম বলেছেন, বাস্তবে প্রমাণ বেশি রেখেছেন। নিজের যাপিতজীবনে নীতি আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত হননি।
১৯৮৯ সালের কথা। মালয়েশিয়ার অবস্থা মোটেই উন্নত নয়। সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-চিকিৎসা কোনো ব্যবস্থাই সমৃদ্ধ বা উন্নত নয়। রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছেন মাহাথীর মোহাম্মদ। পেশায় চিকিৎসক মাহাথীর বুকে ব্যথা অনুভব করলেন। তার স্ত্রীও একজন ডাক্তার। ধরা পড়ল মাহাথীরের হৃদযন্ত্রের সমস্যা। ব্লক আছে। বাইপাস সার্জারি করতে হবে। সেই সময় মালয়েশিয়ার রাজনীতিবিদ-আমলা-ব্যবসায়ীরা চিকিৎসার জন্যে আমেরিকা বা লন্ডনে যেতেন। কেউ কেউ সিঙ্গাপুরেও যেতেন। মাহাথীরের চিকিৎসার উদ্যোগ চলতে থাকল। তাকে নিয়ে যাওয়া হবে লন্ডনে। বিষয়টি জানলেন মাহাথীর। প্রশ্ন করলেন, কেন লন্ডন? কেন মালয়েশিয়া নয়?
বলা হলো, মালয়েশিয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থা যেহেতু অতটা উন্নত বা পরীক্ষিত নয়, সুতরাং এ ধরনের অপারেশনের জন্যে ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থায় অপারেশন করতে হবে, তাতে ঝুঁকি কম থাকবে।
মাহাথীর যুক্তি দিলেন, আমার অপারেশন তো মালয়েশিয়ান ডাক্তাররাই সবচেয়ে গুরুত্ব এবং যত্ন নিয়ে করবেন। তাছাড়া আমাদের ঐতিহ্যও তৈরি করা দরকার। আমরা বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করলে সাধারণ মালয়েশিয়ানরা তো বিদেশেই যাবে, দেশে ভরসা করবেন না। সুতরাং আমার অপারেশন মালয়েশিয়াতেই হবে।
ডা. স্ত্রী রাজি নন, পুরো প্রশাসন রাজি নন। মাহাথীর অনড়। অবশেষে সবাই রাজি হলেন। অপারেশন মালয়েশিয়াতেই হবে। তারপরও সিঙ্গাপুর থেকে যোগাযোগ করলেন লি কুয়ান ইউ। লন্ডনের পরিবর্তে সিঙ্গাপুরে অভিজ্ঞ সার্জনের অধীনে অপারেশন করানোর প্রস্তাব দিলেন। তাতেও রাজি হলেন না মাহাথীর।
মাহাথীরের অপারেশন মালয়েশিয়াতেই হলো, সফলভাবে হলো।
নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে ঘটনাটি বলেছিলেন মাহবুব জামিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন, তার মূল পরিচয়টি যদিও সিঙ্গার বাংলাদেশের মাহবুব জামিলই রয়ে গেছে। বাংলাদেশে সিঙ্গারকে প্রায় শূন্য থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ যে বোয়িংয়ের থেকে নতুন উড়োজাহাজ কিনছে, সেই চুক্তিটি মাহবুব জামিলের করা। এত বিপুল পরিমাণ অর্থের চুক্তিটি হয়েছে কোনো কমিশন বা অসততা বা দুর্নীতির অভিযোগ ছাড়া। যা বিস্ময়কর। কৃষকের সার নিয়ে যে প্রতিবছর কেলেঙ্কারি হতো, তারও সমাধান করে দিয়ে গেছেন মাহবুব জামিল। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে। সিঙ্গারের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও, অপারেশনের সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, বিদেশ নয় দেশেই হবে অপারেশন। প্রসঙ্গক্রমে নিজের ঘটনাটি বলতে গিয়ে এসেছিল মাহাথীর মোহাম্মদ প্রসঙ্গ। মাহাথীর নিজের আত্মজৈবনিক বইয়ে বিষয়টি বিস্তারিত লিখেছেন।
মালয়েশিয়া এখন চিকিৎসা সেবায় পৃথিবীতে তৃতীয়। ঢাকা শহরে কিছুদিন আগেও তাদের বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড চোখে পড়ত। বাংলাদেশ থেকে তো বটেই, ইউরোপ এমন কী অস্ট্রেলিয়া থেকেও মানুষ চিকিৎসার জন্যে মালয়েশিয়াতে আসেন।
আর বাংলাদেশ? হাঁটু, চোখ, কান দেখাতে দলবল নিয়ে চলে যাই সিঙ্গাপুর-লন্ডন-আমেরিকা। এমন কী ডাক্তারদের অনেকে এবং ডাক্তার নেতাদের কেউ কেউ থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুর এমন কী আমেরিকায় চিকিৎসা করিয়ে থাকেন। কাজটি খুব গোপনে করেন বলে, ডাক্তারদের বিষয়টি মানুষ জানেন না, রাজনীতিবিদদের কথা যতটা জানেন।
বাংলাদেশে আরেকটি শ্রেণি আছেন। যারা ভয়ঙ্কর ক্ষমতাবান। রাজনীতিবিদ-মন্ত্রী- এমন কী প্রধানমন্ত্রীকে নিয়েও সমালোচনা করা যায়, তাদেরকে নিয়ে নয়। তারা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হন। তারপর নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করান। সেই মেডিকেল বোর্ডকে দিয়ে লিখিয়ে নেন যে, উন্নত চিকিৎসার জন্যে তার বিদেশ যাওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দুই কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে চিকিৎসা করিয়েছেন এদের মধ্যে এমনও অনেকে আছেন।
বাংলাদেশের বিত্তবান ব্যবসায়ীদের প্রায় সবাই চিকিৎসার জন্যে বিদেশের উপর নির্ভরশীল। সাধারণ মানুষ যাদের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ নেই, তাদেরও অনেকে জমি-জমা বিক্রি করে চিকিৎসার জন্যে ভারতে যান।
লেখার এই অংশটি আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার অত্যন্ত দৈন্যদশার পরিচয় বহন করছে। বাস্তবেও কি বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার চিত্র এতটাই করুণ? এতটা রুগ্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থা আমাদের?
বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার চিত্র সত্যি অত্যন্ত করুণ। এর অর্থ এই নয় যে, ডাক্তারদের অবস্থাও করুণ। সংখ্যায় বেশি না হলেও, বাংলাদেশে অত্যন্ত যোগ্য-দক্ষ-মানসম্পন্ন চিকিৎসক আছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সব শাখায় ভালো ডাক্তার আছেন বাংলাদেশে। তাদের প্রায় সবাই সরকারি হাসপাতালগুলোতে কর্মরত। কিছুসংখ্যক আছেন, যারা বেসরকারি কয়েকটি হাসপাতালে কর্মরত। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলো সামর্থ্যরে তুলনায় পাঁচ-সাত-দশগুণ বেশি মানুষের চিকিৎসা করছেন প্রতিদিন। ডাক্তাররাই চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। কিন্তু সবকিছুর মতো চিকিৎসা ক্ষেত্রেও ‘ব্যবস্থাপনা’ বলে একটি বিষয় থাকার কথা। যার অস্তিত্ব বাংলাদেশের অন্যান্য সেক্টরের মতো চিকিৎসা সেক্টরেও নেই। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ঢাকা কেন্দ্রিক। তাও অত্যন্ত অপর্যাপ্ত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল। এই হাসপাতালটির চিকিৎসা দেয়ার সামর্থ্য আছে ২ হাজার রোগীর। কমপক্ষে ১০ হাজার রোগী সবসময় থাকেন এই হাসপাতালে। ডাক্তারদের সামর্থ্যরে বাইরে পরিশ্রম করতে হয়। সব রোগীর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নজরও দিতে পারেন না। ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় তা আরও বড়ভাবে দৃশ্যমান হয়। একই চিত্র বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, হৃদরোগ ইনস্টিটিউটসহ সব সরকারি হাসপাতালে। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার কোথাও কোনো সুষ্ঠু ‘ব্যবস্থাপনা’ নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত আছে চূড়ান্ত অব্যবস্থাপনা। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকা এবং চূড়ান্ত অব্যবস্থাপনার সঙ্গে ডাক্তারদের প্রায় কোনো সম্পর্ক নেই। সামান্য কয়েকজন রাজনৈতিক ডাক্তারের কিছুটা সম্পর্ক আছে। কিন্তু দায় নিতে হয় সব ডাক্তারদের। ‘ডাক্তাররা খারাপ’ ‘ডাক্তাররা কসাই’ ইত্যাদি বদনাম বহন করতে হয় ডাক্তারদের। কিছু খারাপ ডাক্তার যে নেই, তা নয়। তারা সংখ্যায় খুবই কম।
অতিরিক্ত শ্রম দিয়েও ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে ডাক্তারদের ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ। বাস্তবতা তেমন না হলেও, মানুষের পারসেপশন তৈরি হয়ে গেছে ‘ডাক্তাররা খারাপ’।
লেখার শুরুতে কিডনি প্রসঙ্গ এনেছিলাম। আজ আলোচনা করব কিডনি রোগ, দেশে এর চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার প্রসঙ্গ নিয়ে, সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে নয়।
২.
কিডনি রোগীর মূলত চিকিৎসা ডায়ালাইসিস। কিডনি প্রতিস্থাপনও একটি চিকিৎসা। কিডনি না পাওয়া, প্রতারণাসহ নানা কারণে বর্তমানে যে আইন দেশে বিদ্যমান রয়েছে, তাতে প্রতিস্থাপন এখন হয় না বললেই চলে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা দেড় থেকে দুই কোটি। যারা কিডনি রোগে ভুগছেন তাদের একটা অংশের কিডনি অল্প সময়ের মধ্যে বিকল হয়ে যায়। বিকল কিডনি রোগের ডায়ালাইসিসই চিকিৎসা। প্রতিস্থাপন হয় না বললেই চলে, পূর্বেই বলেছি। দেশে এখন বিকল কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ। প্রতি বছর বাড়ছে প্রায় ৩০ হাজার। ডায়ালাইসিসের অভাবে প্রতিবছর ৪০ হাজার কিডনি রোগীর মৃত্যু হয়।
রোগী আছে ৮ লাখ, প্রতিবছর বাড়ছে ৩০ হাজার। এরকম একটি দেশে কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিন আছে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে ৬৫০টি। এর মধ্যে কমপক্ষে ৪০০ মেশিন নষ্ট! নষ্টের সংখ্যা আরও কিছু বেশিও হতে পারে!!
বিস্মিত হলেও, এটা সত্যি। প্রশ্ন হলো, কেন ডায়ালাইসিস মেশিনের সংখ্যা এত কম, কেনই বা এত মেশিন নষ্ট?
একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘কিডনি ইনস্টিটিউট’-এর দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। এই হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিনের সংখ্যা ছিল ৪২টি। তার মধ্যে ৩০টি নষ্ট। চালু ১২টি। মেশিনগুলো কেনা হয়েছিল ২০০৩-৪ সালের দিকে। মেশিন নষ্ট হবে, মেরামত করা হবে। আবার ঠিক হবে- এমনই তো হওয়ার কথা। কিন্তু না, কিডনি ইনস্টিটিউট নষ্ট মেশিন ঠিক করার উদ্যোগ নেয়নি।
মেশিনগুলো মূলত নষ্ট হয়েছে অযতœ-অবহেলা, অসততা-দুর্নীতির কারণে। ঠিক করার উদ্যোগ নেয়া হলো না কেন?
যেহেতু কিডনি ইনস্টিটিউট ঠিকমতো চলছে না বা চালানো যাচ্ছে না, সরকার ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিল। প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় সরকার চুক্তি করল হায়দরাবাদ ভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্ডরের সঙ্গে। চুক্তি অনুযায়ী সেন্ডর নতুন ৭০টি ডায়ালাইসিস মেশিন আনবে। পুরনো মেশিনগুলো ঠিক না করার ক্ষেত্রে যুক্তি দেখানো হয়েছে, যেহেতু নতুন ৭০টি মেশিন আসবে, সুতরাং ৩০টি নষ্ট মেশিন ঠিক করার দরকার নেই।
সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সেন্ডরের নতুন ৭০টি মেশিন আনার কথা ছিল ২০১৫ সালের জুন মাসের দিকে। তখন থেকেই সরকারি জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট পরিচালনা করার কথা সেন্ডরের। ডাক্তার যারা ছিলেন তারাই থাকবেন। ব্যবস্থাপনার লোকজনসহ যাবতীয় দায়িত্ব পালন করবে সেন্ডর। চুক্তি অনুযায়ী সময়কালে কোনো মেশিন বাংলাদেশে আনতে পারেনি সেন্ডর। সেন্ডর কিডনি ইনস্টিটিউট পরিচালনা করছে ২০১৬ সালের নভেম্বর মাস থেকে। এখন ১৪টি মেশিন চালু আছে। আগে সচল ছিল ১২টি, নতুন আনার কথা ৭০টি। মোট মেশিনের সংখ্যা হওয়ার কথা ৮৪টি। নষ্ট ৩০টি ঠিক করা হলে মেশিনের মোট সংখ্যা হওয়ার কথা ১১৪টি। বাস্তবে শুধু ১৪টি কেন?
একটি সরকার তার নিজের একটি কিডনি ইনস্টিটিউট ঠিকমতো পরিচালনা করতে পারছে না। সে কারণে বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে পরিচালনার দায়িত্ব দিল। সেই প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে চালাচ্ছে কিডনি ইনস্টিটিউট?
মেশিনের সংখ্যাই শেষ কথা নয়। আরও ভয়ঙ্কর ঘটনা সেখানে ঘটছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায়। একটি কিডনি ডায়ালাইজার একবার ব্যবহার করার নিয়ম। একবার ব্যবহার করার কথা, কোনো অবস্থাতেই দ্বিতীয়বার নয়। একটি ইনজেকশনের সিরিঞ্জ যেমন একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হয়, ঠিক তেমন। এত খারাপ অবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশের সর্বত্র এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়। ভারতীয় প্রতিষ্ঠান সেন্ডরের পরিচালনায় একটি কিডনি ডায়ালাইজার একবার নয়, ব্যবহার করা হচ্ছে পনেরো থেকে বিশবার। না, ভুল পড়ছেন না। একদম ঠিক পড়ছেন, পনেরো থেকে বিশবার ব্যবহার করা হচ্ছে, যা একবারের বেশি ব্যবহার করা ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ হতে পারে। ভয়ঙ্কর ক্ষতি হচ্ছেও। যেসব রোগী বারবার ব্যবহৃত ডায়ালাইজারে ডায়ালাইসিস করাচ্ছেন, তাদের শারীরিক অবস্থা, কিডনির অবস্থা ভালোর পরিবর্তে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগে প্রথম আলো রোগীদের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, সপ্তাহে দুইবার ডায়ালাইসিস করছেন এমন রোগীদের শরীরে পানি জমে যাচ্ছে, ওজন বেড়ে যাচ্ছে। অনেক রোগী এমন নানাবিধ সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন, প্রতিদিন পড়ছেন। একবার ডায়ালাইসিসের জন্যে এখানে রোগীরা দিচ্ছেন ৪০০ টাকা, সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে ১৭৯০ টাকা। অর্থাৎ মোট ২১৯০ টাকা পাচ্ছে সেন্ডর। চুক্তি অনুযায়ী সেন্ডর সরকারের থেকে অর্থ ঠিকই পাচ্ছে। সেবা কী দিচ্ছে?
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক নূরুল হুদা সেবা বা রোগীদের অভিযোগ বিষয়ে বলছেন, রোগীদের অভিযোগ একই ডায়ালাইজার বারবার ব্যবহারের বিষয়টি তিনি জানেন। রোগীদের করা লিখিত অভিযোগও তিনি দেখেছেন। কিডনি ইনস্টিটিউট প্রকল্পের (পিপিপি) আওতায় চলে যাওয়ায় তার প্রায় কিছুই করার নেই।
পরিচালকের যদি কিছু করার না থাকে, করার তাহলে আছে কার? বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবসা করতে এসেছে। ব্যবসা করতে এসে তারা সরকারি অবকাঠামো, ডাক্তারের সুবিধা নিয়ে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়ে ব্যবসা করছে। তাদের কর্মকাণ্ড বা ব্যবসার নামে তারা সঠিক কাজটি করছেন কিনা, তা দেখার কেউ থাকবে না?
আছে, দেখার জন্যে আছে ‘ইনভেসকো গ্লোবাল’ নামে স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠান। পিপিপি’র আওতায় প্রতিষ্ঠানটি ঠিকমতো চলছে কিনা, তা দেখার দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠানটির। ‘ইনভেসকো গ্লোবাল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান হায়দারের বক্তব্য, ‘রোগীদের সমস্যার কথা এই প্রথম শুনলাম। আমরা এমন কিছু জানি না। তবে কিডনি ইনস্টিটিউট এবং সেন্ডরের মধ্যে সমন্বয়ের কিছু ঘাটতি আছে যা অচিরেই ঠিক হয়ে যাবে।’
তারা কেমন দেখাশোনা করছেন, কী দেখছেন, কার স্বার্থ দেখছেন- বোঝা গেল। একটি ডায়ালাইজার ২০ বার ব্যবহার করা হচ্ছে, রোগীদের শরীর ফুলে যাচ্ছে, পানি জমে যাচ্ছে, কিডনির অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে, আর দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান কিছু জানেন না, তিনি বলছেন সমন্বয় ঘাটতির কথা!
এ বিষয়ে এখন সেন্ডর অর্থাৎ যারা কর্মটি করছেন তাদের বক্তব্য জানা দরকার। সেন্ডর বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী আবদুল সালাম এ বিষয়ে বলেছেন, ‘রোগীরা অভিযোগ করতেই পারে। সরকারের সঙ্গে সেন্ডরের যে চুক্তি হয়েছে তাতে ডায়ালাইজার বারবার ব্যবহার করা যাবে এমন কথা লেখা আছে।’
কী বুঝলেন? কেমন চুক্তি, কার স্বার্থে চুক্তি? ‘রোগীরা অভিযোগ করতেই পারে’- এ কথাও বলা যায়! কিডনি ইনস্টিটিউটে কর্মরত কোনো ডাক্তার একটি ডায়ালাইজার একবারের বেশি ব্যবহার করতে চান না। কিন্তু ব্যবস্থাপনায় যেহেতু তাদের কোনো হাত নেই, তারা কিছুই করতে পারছেন না। সেন্ডরের নির্দেশ অনুযায়ী একটি ডায়ালাইজার ২০ বার ব্যবহার করছেন। রোগীদের ক্ষতি হচ্ছে ডাক্তাররা দেখছেন, বুঝতে পারছেন। করতে পারছেন না কিছুই।
এভাবেই চলছে পিপিপির আওতায় একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান সরকারের জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট পরিচালনা করে ব্যবসা করছে।
৩.
বাংলাদেশে একবার কিডনি ডায়ালাইসিসের খরচ সবচেয়ে কম ৩০০০ টাকা। যদিও রক্ত পরীক্ষা, ওষুধসহ এই খরচ ৫ থেকে ৬ হাজার টাকার কমে হয় না। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ডায়ালাইসিস করাতে হলে খরচ হয় ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা সাধারণ হাসপাতালে। বড় হাসপাতালগুলোতে খরচ লক্ষাধিক টাকাও হয়ে যায়।
সরকারি কিডনি ইনস্টিটিউটের গল্প তো জানলেন। বাংলাদেশে কিডনি ডায়ালাইসিসের সবচেয়ে ভালো এবং তুলনামূলক কম খরচে সেবা পাওয়া যায় মিরপুরের কিডনি ফাউন্ডেশনে। এখানে ৬৫টি ডায়ালাইসিস মেশিন আছে। সক্ষমতার সঙ্গে এই ফাউন্ডেশনটি পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া আমাদের সরকারি বড় হাসপাতালগুলোর কোনোটির অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক নয়। কয়েক মাস আগে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, দু’টি কিডনি মেশিনের দু’টিই নষ্ট ছিল। রোগীদের ডায়ালাইসিসের জন্যে অন্য বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হতো। এই কয়েক মাসে সেই অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এত বড় একটি হাসপাতাল, এত ভালো ভালো ডাক্তার এত রোগী। কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিন মাত্র ২টি। ২টিই আবার নষ্ট।
এমন অব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে বিদেশি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আসছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের সব সুবিধা ব্যবহার করে ব্যবসা করতে চাইছে। সেই প্রক্রিয়াতেই এসেছে হায়দরাবাদ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সেন্ডর। সেন্ডর বাংলাদেশে যা করছে, ভারতে তা করা অসম্ভব। ভারতের কোথাও ডায়ালাইজার একবারের বেশি ব্যবহৃত হয় না। ভারতে একবার কিডনি ডায়ালাইসিসের খরচ ১ হাজার রুপির মতো। ভারতের অধিকাংশ প্রদেশে ডায়ালাইসিস করার পর রোগীকে সরকারি উদ্যোগে বাড়ি, রেল বা বাস স্টেশনে পৌঁছে দেয়া হয়।
এশিয়ার তাইওয়ান, জাপান, ইরানে বিনা খরচে কিডনি ডায়ালাইসিস করার সুবিধা পান রোগীরা। উত্তর আমেরিকার কানাডা, কিউবায় বিনা খরচে ডায়ালাইসিস ব্যবস্থা রয়েছে। এমন কী পাকিস্তানের করাচিসহ আরও কিছু জায়গায় বিনা খরচে ডায়ালাইসিস সুবিধা চালু আছে।
৪.
এটা শুধু কিডনি রোগ চিকিৎসার চিত্র নয়, বাংলাদেশের সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার চিত্র এর চেয়ে আলাদা কিছু নয়। কিডনি চিকিৎসার এই করুণ পরিস্থিতিতে একটি অসাধারণ উদ্যোগের কথা জানা যাচ্ছে। উদ্যোগটি নিয়েছেন ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। স্বাধীন দেশে সাধারণ মানুষের জন্যে গড়ে তুলেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতির কারণে বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের উত্থান হয়েছে। তার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী। তিনি নিজে এখন কিডনি রোগী। তার দু’টি কিডনি নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয়। নিজে রোগী হয়ে সাধারণ কিডনি রোগীদের দুর্ভোগের বিষয়টি বেশি করে অনুধাবন করেছেন।
সাধারণ জনমানুষের জন্যে অত্যাধুনিক ‘গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টার’ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। এই কেন্দ্রে থাকবে ১০০টি অত্যাধুনিক ডায়ালাইসিস মেশিন। ৬ বেডের আইসিইউসহ কিডনি রোগীদের জন্যে ইউরোপ-আমেরিকার মানে চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা। কেন্দ্রটি খোলা থাকবে ২৪ ঘণ্টা। প্রতিদিন প্রায় ৫০০ রোগী কিডনি ডায়ালাইসিসের সুবিধা পাবেন। মাত্র ১০০ টাকার বিনিময়ে ঢাকার রোগীদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হবে। সবচেয়ে আনন্দের তথ্য, খরচ হবে অন্য যে কোনো হাসপাতালের চেয়ে অনেক কম। অতি দরিদ্ররা বিনামূল্যে, দারিদ্র্যরা ১১০০ টাকায়, মধ্যবিত্ত ১৫০০ টাকায়, উচ্চবিত্তরা ৩০০০ টাকা বা ইচ্ছেমতো এর চেয়ে বেশি দিয়ে ডায়ালাইসিস করতে পারবেন। রক্ত পরীক্ষা, ইনজেকশনসহ অন্যান্য ওষুধ বাজার মূল্যের চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগ দামে পাওয়া যাবে।
কেন্দ্রটি গড়ে তোলার জন্যে মোট ৫০ কোটি টাকা প্রয়োজন। ব্র্যাক ১০ কোটি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসহ এখন পর্যন্ত ৩৮ কোটি টাকার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। ১২ কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে। কম-বেশি যে কোনো পরিমাণ সহায়তা গ্রহণ করা হবে, জানালেন ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী। যেহেতু ঢাকার গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল প্রথমাবস্থায় ৩৫ হাজার বর্গফুট পরে প্রয়োজনে আরও ২৫ হাজার বর্গফুট জায়গা দিবে বিনা ভাড়ায়, ফলে অনেক কম অর্থ ব্যয়ে এমন একটি অত্যাধুনিক কিডনি ডায়ালাইসিস কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে। কেন্দ্রটি উদ্বোধন হওয়ার কথা রয়েছে এ বছরের মার্চ মাসে। সে কারণে আরও ১০/১২ কোটি টাকা খুব জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন।
চিকিৎসা ব্যবস্থার হাজারও হতাশার মাঝে একটি আশার আলো অলাভজনক ‘গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টার’।
৫.
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা দিন দিন কতটা কমে যাচ্ছে, তা ভাবার কেউ নেই। ভাবলে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। একটি সরকারি কিডনি ইনস্টিটিউট, জায়গা-অর্থ-লোকবল-ডাক্তার, সব সুবিধা থাকার পরও পরিচালনা করার সক্ষমতা নেই। স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের এই সক্ষমতা নেই। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে ছেড়ে দিতে হচ্ছে পরিচালনার দায়িত্ব!
বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে পরিচালনা করার জন্যে যে সক্ষমতা থাকতে হয়, তাও আমাদের সরকারের নেই। ফলে বিদেশি প্রতিষ্ঠান যা ইচ্ছে তাই করছে। রোগীদের জীবন নিয়ে খেলছে, কেউ কোথাও নেই তা দেখার!
হাসপাতালের নামে পরিচালিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো স্বেচ্ছাচারিতার চূড়ান্ত করছে। পরীক্ষা তো প্রশ্নবিদ্ধ বটেই, মূল্যের ক্ষেত্রেও স্বেচ্ছাচারিতার চূড়ান্ত করছে। কোনো নিয়ম-নীতি ছাড়া এক একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনেক বেশি মূল্যে সাধারণ পরীক্ষাগুলো করছে। যে রক্ত পরীক্ষা ডা. কামরুজ্জামানের কমিউনিটি হাসপাতালে বা ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ৩০০ টাকা, সেই পরীক্ষা বেসরকারি মাঝারি হাসপাতালে ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা। বড় হাসপাতালে তা ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা।
প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকার মেডিকেল মেশিনারিজ কেনা হচ্ছে। এক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি যে কি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তা লিখে বোঝানো কষ্টকর। তিনটি ঘটনা বলি-
ক. এক সময়ের ছাত্রলীগ নেতা, এখন ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত। রোগীদের প্রিয় ডাক্তার। অনেক যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি যন্ত্র তার বিভাগের। তাকে সেটা বুঝে নিতে হবে। বুঝে নিতে গিয়ে তিনি দেখলেন, যন্ত্রটি নির্মাণ হওয়ার কথা অস্ট্রেলিয়ায়। উপরের প্যাকেটে আলাদা কাগজ লাগানো হয়েছে ‘মেড ইন অস্ট্রেলিয়া’ লেখা। ভেতরে যন্ত্রের গায়ে লেখা ‘মেড ইন চায়না’। যন্ত্রটি বাজারমূল্য ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। কেনা হয়েছে ৯ কোটি টাকা দিয়ে। তিনি অস্বীকৃতি জানালেন বুঝে নিতে। সরবরাহকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টানাপড়েন চলল কিছুদিন। এক পর্যায়ে ঊর্ধ্বতন কেউ কেউ তাকে বললেন, কী করছেন আপনি, এখনও বুঝে নেননি? গুম হয়ে যাবেন তো! জানেন এর সঙ্গে কারা জড়িত?
খ. বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। ২৫ লাখ টাকার মেডিকেল যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার কাজ। ৫০ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে কাজটি পেলেন এক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ২৫ লাখ টাকার কাজ, ৫০ লাখ টাকা ঘুষ? কেমন গোলমেলে ব্যাপার। তাই আবার হয় নাকি! হ্যাঁ, বাংলাদেশে তা-ই হয়। ২৫ লাখ টাকার কাজ চার দফায় বাড়িয়ে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা করা হয়েছিল। আপনি বিশ্বাস করতে না চাইলেও, তথ্য অসত্য নয়।
গ. কোন হাসপাতালে কি যন্ত্রপাতি প্রয়োজন তা নির্ধারণ করেন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল পরিচালনা কর্তৃপক্ষ নয়। পাবনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ঠিকাদারের দেয়া তালিকায় স্বাক্ষর না করায় তাৎক্ষণিক বদলির স্বীকার হয়েছিলেন। এই ঘটনাটি নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে অবশ্য সেই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি। বাংলাদেশের প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে এই পদ্ধতিতেই যন্ত্রপাতি কেনা হয়।
৬.
বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় ব্যবস্থাপনা বলতে কিছু গড়ে ওঠেনি। যা ছিল তাও ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু। ভালো ডাক্তাররা পরিশ্রম করছেন, সেবা দিচ্ছেন। সুনামের অধিকারী না হয়ে ‘কসাই’ আখ্যা পাচ্ছেন। একজন নিবেদিত ডাক্তার সংবাদের শিরোনাম হতে পারছেন না। সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে নার্স নিয়োগকে কেন্দ্র করে ‘ভিসি-প্রো ভিসির কোন্দল।
অব্যবস্থাপনার পরিণতিতে রোগীদের বিদেশ যাওয়া কমছে না। এখন আবার সরকার নিজেই পরাজয় স্বীকার করে বিদেশি প্রতিষ্ঠান ডেকে আনছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্যে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, কতটা লজ্জা, কতটা অসম্মানের- তা অনুধাবন করাও সম্ভবত জাতি হিসেবে আমরা ভুলে গেছি, যাচ্ছি।
আমরা ঢাকাকে সিঙ্গাপুর বানাতে চাই। অথচ একটি ফুটওভার ব্রিজে কিছু গাছ লাগিয়ে তা পরিচর্যা করতে পারি না। পরিচর্যার অভাবে গাছ মারা যায়। বিচ্ছিন্নভাবে ফুটওভারে গাছ লাগিয়ে, হকার উচ্ছেদ করে, ভালো ফুটপাত ভেঙে নতুন করে গড়ে যে সিঙ্গাপুর বানানো যায় না, তা আমাদের চিন্তায় স্থান পায় না। সিঙ্গাপুর বানানো যে একটি সামগ্রিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পিত উন্নয়ন, তা ভাবতেই চাই না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পিত উন্নয়ন মানে শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন- তা বোঝার সক্ষমতাই সম্ভবত আমাদের গড়ে ওঠেনি। উঠবে কিনা কোনো দিন, আতঙ্কের প্রশ্ন সেটাই।
[বাংলাদেশের জনপ্রিয় ধারার সাপ্তাহিক পত্রিকা “সাপ্তাহিক” ভেরিফাইড প্রেসের কন্টেন্ট পার্টনার। লেখা সম্পর্কিত আপনার যেকোনো মতামত আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারেন নিচের মন্তব্য বক্সে বা ভেরিফাইড প্রেসের ফেসবুক পাতায়।]
Leave a Reply