দুশ্চিন্তার সাথে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। অনেকের কাছে এটা অন্যান্য পাঁচটা জিনিসের মতন স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হলেও অনেকের ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তা থেকে হতাশার জন্ম নেয়; যা আরও বাজে ফলাফল বয়ে আনে।

তবে দুশ্চিন্তা যার যেমনই হোক না কেন, একটা ব্যাপার নিশ্চিত করে বলা যায়। সেটা হলো, দুশ্চিন্তার পরিমাণ যত বাড়ে, সেটি তত বাজে দিকে মোড় নেয় আর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করে। একটা পর্যায়ে দুশ্চিন্তামুক্ত হবার কোনো পথ আর খোলা থাকে না। পাশাপাশি, দুশ্চিন্তামুক্ত হতে গিয়ে পুরো ব্যাপারটিকে আরও বাজে করে ফেলার অসংখ্য উদাহরণও নিজের জীবনেই পাবেন।
দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির বিভিন্ন উপায় নিয়ে মানুষ বহুদিন ধরে আলোচনা করে আসলেও সমাধানটা বেশ আগে থেকেই আছে। আর সেটা আছে বৌদ্ধ ধর্মে। চলুন এরকম তিনটি সমাধান সম্পর্কে জেনে আসা যাক।
কোনো পরিস্থিতি থেকে পালানোর চেষ্টা না করে সেটাকে স্বীকার করে নেওয়া
দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হলে চিন্তা না করে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়ে। তবে এক্ষেত্রে জেন মাস্টার বলে পরিচিত বৌদ্ধধর্মের মেডিটেশনের শিক্ষক সুনর্যু সুজুকির কাছে বেশ কিছু সমাধান আছে।
নিজেদের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে আমরা প্রায়ই বুঝতে পারি যে এতে করে আরও নতুন নতুন চিন্তা মাথায় আসছে। ব্যাপারটা অনেকটা আগুন দিয়ে আগুন নেভানোর মতন হয়ে যায়। যদিও আপাতদৃষ্টিতে এটাকেই বেশি যৌক্তিক কাজ বলে মনে হয়। তবে সুজুকির মতে, দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির জন্যে একেবারে ঠাণ্ডা মাথায় যত চিন্তাই আসুক না কেন, সেগুলো নিয়ে পরে না থাকার পরামর্শ দেন। মস্তিষ্কে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা এবং ছবি যেভাবে হঠাৎ করে আসবে তেমনি চলেও যাবে। আমরা সেগুলিকে সরানোর চেষ্টা করলে বা সেগুলি নিয়ে চিন্তা করা শুরু করলেই বরং সেটি স্থায়ী হবে।
অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন চিন্তা (এমনকি দুশ্চিন্তাও) বেশ ভালো কিছু সমাধানও বয়ে আনে। তাই নিজেকে চিন্তামুক্ত করা প্রচেষ্টাটা মোটেও ভালো কোনো লক্ষণ না। বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা অনুযায়ী, একটি ব্যথাকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালানোর চেয়ে সেটিকে গ্রহণ করে নিলেই কম কষ্ট হয়। তাই নিজের ভেতর এই অভ্যাসটা গড়ে তোলা ভালো।
পরিবর্তনকে গ্রহণ করে নেওয়া
সুজুকি মনে করেন, দুশ্চিন্তা কমানোর অন্যতম প্রধান উপায় যেকোনো পরিবর্তনকে মেনে নেওয়া।
জগৎ পরিবর্তনশীল। এই সাধারণ ব্যাপারটিকে গ্রহণ করতে না পারলে আমরা কখনোই শান্তি খুঁজে পাবো না। সবসময়ই আমাদের আশেপাশে কিছু না কিছু বদলাবে, আর সেই বদলের সাথে সাথে নতুন নতুন দুশ্চিন্তা আমাদেরকে গ্রাস করবে।
শুধুমাত্র দুশ্চিন্তার ব্যাপারটি যে এখানে কাজ করে সেটাই নয়। আমরা প্রায়ই সবকিছুর একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতর আটকা পড়ি। আমাদের পোশাক-আশাক, শরীর, ব্যক্তিত্বকে আমরা একটি নির্দিষ্ট অপরিবর্তনযোগ্য বিষয় বলে মনে করি। আর সেজন্য যখনই এগুলোয় কোনো পরিবর্তন আসে, আমরা তটস্থ হয়ে যাই।
সুজুকি মনে করেন, আমাদের চেতনায় সবকিছু যেভাবে আসে সেভাবে চলেও যায়। কিন্তু নতুন কিছু যখন আগে তখন সাথে করে বিভিন্নপ্রকার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক আবেগকেও নিয়ে আসে। নেতিবাচক আবেগগুলোর ভেতর আছে ভয়, দুশ্চিন্তা, রাগ বা হতাশা। আমরা যদি বুঝতে পারি যে এই অনুভূতিটা যেভাবে হঠাৎ করে এসেছে সেভাবে হঠাৎ করে চলেও যাবে, তাহলে আমরা এর ফলে সৃষ্ঠ সম্ভাব্য সমস্যা থেকেও মুক্তি পেতে পারি।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, হঠাৎ করে কিছু একটা ঘটলে রেগে যাওয়াটাকে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা যদি এটা বুঝতে পারি যে কিছুক্ষণের মধ্যে আমি রাগি বা না রাগি, অবস্থাটা আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে; তাহলে অনেক অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি বা দুশ্চিন্তাকে এড়ানো সম্ভব।
নিজের সবগুলি ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগানো
হঠাৎ করে হল ভর্তি মানুষজনের সামনে স্টেজে উঠেছেন কখনো? হঠাৎ করে অসংখ্য ভয় আর দুশ্চিন্তা একসাথে এসে ভর করে তখন। সবচেয়ে সহজ সমাধানটা হয় চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস নিলে। মনে হয় যেনো বাড়তি সব চাপ নিঃশ্বাসের সাথে সাথে শরীর থেকে বেড়িয়ে যায়। এরকম বড় করে নিঃশ্বাস নেওয়া আর নিজের সম্পূর্ণ মনোযোগ সেদিকে দেওয়াটাকে দুশ্চিন্তা দূর করার একটা মোক্ষম উপায় বলে মনে করা হয়।
আধুনিক নিউরোসায়েন্স মানুষের মস্তিষ্কে দুই ধরণের নেটওয়ার্কের সন্ধান পেয়েছে। যার ভেতর একটিকে বলা হয় “ডিফল্ট নেটওয়ার্ক” আর অন্যদিকে বলা হয় “ডিরেক্ট এক্সপেরিয়েন্স নেটওয়ার্ক”।
আমাদের মস্তিষ্কে সচরাচর চালু থাকে ডিফল্ট নেটওয়ার্ক। বিশেষ করে আমরা যখন চিন্তায় ডুবে থাকি তখন এই নেটওয়ার্কটি কাজ করে। অন্যদিকে “ডিরেক্ট এক্সপেরিয়েন্স নেটওয়ার্ক”টি তখনই চালু হয় যখন আমরা অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা না করে সরাসরি আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে ব্যবহার করে আমাদের পারিপার্শ্বিকতা থেকে বিভিন্ন প্রকারের তথ্য নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় গরম পানি দিয়ে গোসল করার ব্যাপারে। গরম পানিতে গোসল করার সময় আপনার শরীর পানির উষ্ণতাটা ধরতে পারে। এটির জন্যে আপনাকে চিন্তা করতে হচ্ছে না। আপনার শরীর যে অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে আপনি সরাসরি সেটাকে অনুভব করতে পারছেন।
তবে অনেক সময় এই দুই প্রকারের নেটওয়ার্ক একইসাথে কাজ করে। আর এমনটা ঘটলে ডিফল্ট নেটওয়ার্কই আমাদের চিন্তাচেতনার সিংহভাগ দখল করে বসে থাকে। অনেক সময় দেখবেন আপনি কিছু একটা করছেন ঠিকই, কিন্তু চিন্তা করছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ব্যাপার নিয়ে। আপনি যে কাজটা করছেন সেটা ডিরেক্ট এক্সপেরিয়েন্স নেটওয়ার্কের অংশ হলেও চিন্তাটা হবে ডিফল্ট নেটওয়ার্কেল অংশ।
সেজন্য মাঝেমধ্যেই দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে এই দুই ধরণের নেটওয়ার্কের ভেতর সামঞ্জস্যতা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা পড়ে। দীর্ঘ সময় ধরে নিঃশ্বাস নিয়ে সেদিকে মনোযোগ দিলে যেটি করা সম্ভব হয়। সেজন্য এটিকে দুশ্চিন্তা তাড়ানোর একটি মোক্ষম উপায় বলেও মনে করা হয়।
[[লেখা সম্পর্কিত আপনার যেকোনো মতামত আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারেন নিচের মন্তব্য বক্সে বা ভেরিফাইড প্রেসের ফেসবুক পাতায়।]]
Leave a Reply