বঙ্গভঙ্গের দরুণ সম্পর্কে ফাটল ধরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের উদারপন্থী ও চরমপন্থী নেতৃবৃন্দের মধ্যে । ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ । ১৯০৭ সালে সুরাটের এক অধিবেশনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বিভক্ত হয়ে যায় ।

শুরু থেকেই কংগ্রেসে উদারপন্থী ও চরমপন্থী দুটো পক্ষ ছিলো । দুই পক্ষের মধ্যে প্রতিষ্ঠালগ্নে সুসম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও পরবর্তীতে রাজনৈতিক অস্থিরতায় দুই পক্ষ বিভক্ত হয়ে যায় । এদিকে ১৮৯২ সালে শুরু হয় হিন্দু পুনর্জাগরণ । এই পুনর্জাগরণের পিছনে বিভিন্ন কারণ ছিলো । তখন ব্রাহ্মসমাজ, বৌদ্ধ ও মুসলিমরা সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে হিন্দুত্ববাদ তখন ধ্বংসের মুখে পড়ে । বেশ কয়েকজন হিন্দু নেতার উদ্যোগে এই পুনর্জাগরণ শুরু হয় । তখন থেকেই মূলত ব্রিটিশরা প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বঙ্গভঙ্গের কথা ভাবতে থাকে ।
১৯০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা দেন । ঘোষণা কার্যকর করা হয় ১৫ অক্টোবর । এর মাধ্যমে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন একটি প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ নামে আরেকটি প্রদেশ গঠন করা হয় । পূর্ববঙ্গ ও আসামের মধ্যে পড়ে ঢাকা বিভাগ, রাজশাহী বিভাগ, চট্টগ্রাম বিভাগ, দার্জিলিং ও ময়মনসিংহ এবং আসাম আর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে পড়ে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা । পূর্ববঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন স্যার বামফিল্ড ফুলার আর পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এন্ড্রু ফ্রেজার ।
বঙ্গভঙ্গের ঠিক এক বছর পর ঢাকায় গঠিত হয় মুসলিম লীগ । বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকার সলিম নেতারা একথা বোঝাতে সক্ষম হন যে বঙ্গভঙ্গ হলে মুসলিমদের ভালো হবে । তাই হিন্দুদের আন্দোলনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মুসলিমরা উল্লসিত হয় বঙ্গভঙ্গের ফলে । আর হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানায় নি । তারা মনে করতে থাকে বঙ্গভঙ্গের মানে হলো বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ । তারা দেবী দূর্গার কথা বলে এবং বাংলাকে দূর্গা হিসেবে কল্পনা করতে থাকে ।
বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে এই বিষয়ে । সেখানে বলা হয়েছে এভাবে, ‘যুদ্ধ এখন সমাপ্ত । এখন আর কোনো রক্তপাত নয় ।’ তখন সিপাহী বলছে, ’এখন তো কেবল ব্রিটিশদের হাতেই রয়ে গেছে ক্ষমতা । হিন্দু রাজত্ব তো প্রতিষ্ঠিত হয় নি ।’ তখন রাজা বললেন, ‘সে অনেক দেরী ।’
এখানে আমরা দেখতে পাই, হিন্দু রাজত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে । হিন্দু রাজত্ব বলতে এখানে ভারতে হিন্দুদের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে । হিন্দুরা সংখ্যায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও তাদের প্রভুত্ব কায়েম হচ্ছে না । বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দুদের ব্রিটিশদের প্রতি বীতশ্রদ্ধতার প্রমাণ করে ।
১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর লর্ড মিন্টো আকস্মিকভাবে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা দেন ।
তখন হিন্দুরা খুশী হয় । তবে মুসলিমরা হতাশ হয়ে পড়ে । ফলে এসময় মুসলিমরা ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে । তখন ঢাকা শহরে স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলতে ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ প্রভৃতি । ফলে মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য এই অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিলো । ব্রিটিশরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য । কিন্তু ১৯১৪ সালে সমগ্র বিশ্ব বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পিছিয়ে যায় ।
১৯১২ সালের নাথান কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় । বঙ্গভঙ্গ ভারতের রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছে । বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে ।
মূলত বঙ্গভঙ্গ ছিলো শাসনের অজুহাতে দুই বাংলার মানুষের মনে সাম্প্রদায়িক অনৈক্য সৃষ্টির পায়তারা। কিন্তু মুসলমানদের কথা শুনতে গিয়ে হিন্দুদের দুই চোখের বিষ হলে ব্রিটিশরা সুযোগ বুঝে বঙ্গভঙ্গ রদ করে দেয়। তার ফলে মুসলিমদের দুইচোখের বিষ হয় ব্রিটিশরা। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে মুসলিমরা ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি করলে ব্রিটিশরা ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ।
বঙ্গভঙ্গের ফলে ১৯০৭ সালে কংগ্রেসের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয় এবং উদারপন্থী নেতারা চরমপন্থী নেতাদের সুরাট অধিবেশনে প্রত্যাখান করেন । ফলে তাদের মধ্যে মতবিরোধ চরম রূপ লাভ করে । ১৯১৯ সালে মহাত্মা গান্ধী সত্যাগ্রহ আহবান করলে ১৯২০ সালে মুসলিমরা খিলাফত আন্দোলনের ডাক দেয় । ১৯২১ হিন্দু ও মুসলিম একত্রে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করলে রাজনৈতিকভাবে হিন্দু ও মুসলিমদের সাময়িক ঐক্য স্থাপিত হলে ১৯২৩ সালের অপ্রীতিকর ঘটনার পর গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন সমাপ্ত ঘোষণা করেন । ১৯২৪ সালে খিলাফত আন্দোলন সমাপ্ত বলে ঘোষণা করা হয় ।
এদিকে ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্যাক্ট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । এই চুক্তি স্বাক্ষর করতে ভূমিকা রাখেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ । তিনি ১৯২২ সালে গয়ায় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন এবং সেসময় তিনি যে এন্টি প্রোগ্রাম পেশ করেন, তা কংগ্রেসের সভা প্রত্যাখান করলে তিনি পদত্যাগ করেন এবং স্বরাজ পার্টি গঠন করেন । এই পার্টি গঠনের পর তিনি ব্রিটিশদের সাথে যে চুক্তি করেন তা ইতিহাসে বেঙ্গল প্যাক্ট নামে সমধিক পরিচিত । এই চুক্তির কয়েকটি ধারা উল্লেখ করা হলো–
১. বঙ্গীয় আইন সভায় প্রতিনিধিত্ব পৃথক নির্বাচক মন্ডলীর মাধ্যমে জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে ।
২. স্থানীয় পরিষদসমূহে প্রতিনিধিত্বের অনুপাত হবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের শতকরা ৬০ ভাগ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শতকরা ৪০ ভাগ ।
৩. সরকারি চাকরির ৫৫% পদ পাবে মুসলিমরা । যতদিন ঐ অনুপাতে না পৌছানো যায় ততদিন মুসলিমরা পাবে ৮০% ও হিন্দুরা পাবে ২০% । সরকারি চাকরি ছাড়াও কলকাতা কর্পোরেশন, জেলা ও স্থানীয় বোর্ড তথা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহে মুসলিমরা ঐ হারে চাকরি পাবে ।
৪. কোনো সম্প্রদায়ের স্বার্থের পরিপন্থি কোনো আইন বা সিদ্ধান্ত ঐ সম্প্রদায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ৭৫% এর সম্মতি ছাড়া উপস্থাপন করা যাবে না ।
৫. মসজিদের সামনে বাদ্য সহকারে শোভাযাত্রা করা যাবে না ।
৬. খাদ্যের জন্য গরু জবাই নিয়ে আইন সভায় কোনো আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া যাবে না । আইন সভার বাইরে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা আনার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে । গরু জবাই করার সময় যাতে তা হিন্দুদের দৃষ্টিতে পড়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করে তার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ধর্মীয় কারণে গরু জবাইয়ের ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না ।
এই চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে দুই বাংলায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় । হিন্দু নেতারা এই চুক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন । তবে মুসলিমদের ভেতরে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এই চুক্তির মধ্য দিয়ে । চুক্তি বিরোধী হিন্দু নেতৃবৃন্দ বলেন যে স্বরাজ্য দল ও কংগ্রেস কমিটি এই চুক্তি পাস করলেও কংগ্রেসের কাশ্য অধিবেশনে চিত্তরঞ্জন দাশ ব্যর্থ হবেন । শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, সুরেন্দ্র্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিপিন চন্দ্র পালসহ অধিকাংশ হিন্দু নেতা এই চুক্তিকে একতরফা চুক্তি বলে অভিযোগ করেন । হিন্দু গণমাধ্যমগুলো এর বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু করে ।
নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এই চুক্তি কার্যকর হলেও সম্প্রীতি স্থাপনের দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় মূলত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে । ১৯৪৬ সালের কলকাতা ও নোয়াখালীতে দাঙ্গার ফলে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে । এদিকে, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী জিন্নাহ মুসলিমদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করার চেষ্টা চালাতে থাকেন । তার সেই প্রচেষ্টা আপাতদৃষ্টিতে সফল হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যর্থ ।
সম্পাদনা: মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম
তথ্যসূত্র: উচ্চ মাধ্যমিক পৌরনীতি দ্বিতীয় পত্র, প্রফেসর মোজাম্মেল হক
জিন্না: ভারত দেশভাগ স্বাধীনতা, যশোবন্ত সিংহ
আনন্দমঠ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
[[লেখা সম্পর্কিত আপনার যেকোনো মতামত আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারেন নিচের মন্তব্য বক্সে বা ভেরিফাইড প্রেসের ফেসবুক পাতায়।]]
Leave a Reply