
দেশের শীর্ষ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন। নিজেদের তারা এই খাতের এক নম্বর নেটওয়ার্ক ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানকারী কোম্পানি হিসেবে দাবি করে। বিভিন্ন সময় তারা নিজেরাই নিজেদের গ্রাহকদের আস্থার প্রতীক হিসেবে সাব্যস্ত করে বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে। কিন্তু গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে এবং গ্রামীণফোনের বিভিন্ন প্যাকেজ ও অফার পর্যালোচনা করলে উঠে আসে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। গ্রাহকরা বরাবরই কোম্পানিটির ওপর বিরক্ত। কিন্তু অনেক দিন ধরে একটি ফোন নম্বর চালানোর ফলে, তা অনেকের কাছে পরিচিত বিধায় চাইলেই তারা নম্বর পাল্টে ফেলতে পারেন না। আর এই সুযোগে গ্রামীণফোন তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে। গ্রাহকদের ওপর তারা চাপিয়ে দিচ্ছে সর্বোচ্চ ব্যয়, আর তার ওপর দাঁড়িয়ে করছে বিপুল মুনাফা। সাধারণ হিসাব বলে, কোনো খাতের শীর্ষ কোম্পানি অবশ্যই গ্রাহকদের সুযোগ-সুবিধা বেশি দেবে। মূল্যহার নিচের দিকে রাখার সক্ষমতা তাদেরই বেশি থাকে। কিন্তু মোবাইল খাতে গ্রামীণফোন যেন এর উল্টো। অন্য সব কোম্পানির চেয়ে তারাই সবচেয়ে বেশি টাকা কাটছে।
পান্থপথ নিবাসী প্রকৌশলী তানভীর ফয়সাল ০১৭১১ সিরিজের গ্রামীণফোনের একটি নম্বর ব্যবহার করছেন অনেক দিন ধরে। প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, অনেক দিন ধরে নম্বরটি ব্যবহার করছি। অনেকের কাছে নম্বরটি দেয়া আছে। ফলে নম্বরটি পাল্টালে অনেকে খুঁজে পাবে না, এই ভীতি কাজ করে। আবার বিভিন্ন সময় যাদের সঙ্গে কাজ করেছি, আমার ঠিকানা হিসেবে কেবল এই নম্বরটিই তাদের কাছে রয়েছে। ফলে কলরেট সবচেয়ে বেশি হওয়া সত্ত্বেও ফোন নম্বরটি পাল্টাতে পারছি না। অনেকেই এই সমস্যায় আছে। বন্ধুদের মধ্যে কাউকে কাউকে দেখেছি, এ কারণে দুই তিনটা অপারেটরের সিম ব্যবহার করে। যখন যে কোম্পানির কলরেট কম, তখন সেটার সিম লাগিয়ে কাজ করে। কিন্তু এটা তো একটা নির্যাতন। এত সময় যদি ফোনের পেছনে দিতে হয়, তাহলে আর কাজ করব কখন। কলরেট তো এখন ভ্যাটসহ যেকোনো অপারেটরের ক্ষেত্রেই এক টাকার কম হওয়া উচিত।
আরও কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলেও পাওয়া যায় একই প্রতিক্রিয়া। অধিকাংশ মানুষের অভিজ্ঞতা এবং অভিযোগ একই রকম। কিন্তু আমাদের গণমাধ্যমগুলো বিচিত্র কোনো কারণে ফোন কোম্পানি সম্পর্কে জনগণের নানা অভিযোগকে এড়িয়ে যেতে পছন্দ করে। এর পেছনেও ফোন কোম্পানিগুলোর হাত রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। অনলাইনে সামাজিক নানা মাধ্যমে গ্রাহকরা এসব নিয়ে প্রতিনিয়তই নানা ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করে চলেছেন। কিন্তু সেসবের সুরাহা করার যেন কেউ নেই। ফোন কোম্পানিগুলো সরকারের কাছে সোনার ডিম পাড়া হাসের মতো। তাদের কাছ থেকে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আদায় করে। ব্যক্তিবিশেষদের উপরি আয়ও এই খাত থেকে কম নয়। ফলে কোম্পানিগুলোকে কলরেট কমাতে বাধ্য করা দূরে থাক, উল্টো কলরেট বৃদ্ধিতে সরকারের আগ্রহের কথা শোনা যায়। এতে গ্রাহকরা আরও হতাশ।
রাজধানীর খ্যাতনামা একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্মকর্তা বাবু আহমেদ সুদীর্ঘ সময় ধরে গ্রামীণফোনের গ্রাহক। তিনি বলেন, খুবই যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি। পাশের দেশে যেখানে ফোনকলের ওপর এখন তেমন কোনো চার্জই নেই, সেখানে এই দেশে বসে এখনও প্রতি মিনিট দুই টাকায় বা কখনও তার বেশি হারেও টাকা গুণে যেতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় অস্বাভাবিক হারে টাকা কেটে নিলো। এমনকি অভিযোগ কেন্দ্রে ফোন করলেও দুই টাকা করে কাটতে থাকে। একবার এরকম ফোন দিয়ে প্রায় মিনিট দশেক অপেক্ষা করেও সংযোগ না পেয়ে শেষে কলটি কেটে দিয়ে বেরিয়ে এসেছি। অভিযোগ আর জানানো হলো না। ব্যবসায় নীতি যতটুকু বুঝি, কোম্পানিকে গ্রাহক অভিযোগ জানালে তো কোম্পানি লাভবান হয়। এতে গ্রাহক ও কোম্পানির মধ্যে সম্পর্ক ভালো হয়। গ্রাহকের অভিযোগ সমাধান হলে, গ্রাহক নিজেই কোম্পানির হয়ে প্রচার চালাতে থাকে। আবার অভিযোগের মধ্য দিয়ে সার্ভিসের সমস্যা সংশোধনের পরামর্শ কোম্পানিটি বিনা খরচেই পেয়ে যায়। অথচ এখানে অভিযোগ করতে টাকা লাগে। টাকা দিয়েও অভিযোগ করা যায় না, বসে থেকে আরও টাকা ব্যয় করতে হয়। এটা আসলে অভিযোগ বন্ধ করারই একটি প্রক্রিয়া, এভাবে তারা গ্রাহকদের মুখ বন্ধ করে রাখছে। বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করি বিধায় এটা খুব ভালো করেই জানি যে, এত ঝামেলা করেও কীভাবে ফোন কোম্পানিগুলো বহাল তবিয়তে আছে। এখানে ওখানে তারা অনেক টাকা ঢালে, অনেক কিছু স্পন্সর করে। কিন্তু গ্রাহকদের অভিযোগগুলো সমাধান করলেই বোধ করি, তারা বেশি লাভবান হতো।
বাবু আহমেদের এই অভিজ্ঞতা যেন সারাদেশের অভিজ্ঞতা, তার অভিযোগ আসলে ফোন ব্যবহারকারী সবারই অভিযোগ। ফোন কোম্পানিগুলোকে কনসার্ট করা, সারাদেশ বিজ্ঞাপনে ছেয়ে ফেলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতে আমরা টাকা ব্যয় করতে দেখি। এরপর শুনি তাদের বিপুল মুনাফার কথা। এগুলো তারা করছে গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ দিয়েই। অথচ গ্রাহকদের অভিযোগ শোনার সময়ই তাদের নেই। সমস্যাগুলো সমাধান করার কথা তো দূরেই। শীর্ষ কোম্পানি হওয়ায় গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে অভিযোগটা একটু বেশি। এসব অভিযোগের সত্যতা খুঁজতে আমরা অনুসন্ধান করেছি ফোন কোম্পানিগুলোর কলরেট নিয়ে। তালিকার প্রথম দিকের তিনটি কোম্পানির মধ্যে দেখা যায় গ্রামীণফোনের কলরেটই সবচেয়ে বেশি।
কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইটে ঢু মেরে দেখা যায়, কোনো কোম্পানিই বলছে না এক মিনিটে কার কলরেট কত? ভেঙে ভেঙে ১০ সেকেন্ড বা ২০ সেকেন্ডের খরচের হিসাব দেয়া আছে। এতে গ্রাহকের মনে হয় যেন ব্যয়টা কমই, অর্থাৎ তাদের বিভ্রান্ত করা হয়। প্রিপেইড গ্রাহকদের ব্যবহৃত প্যাকেজগুলোকে আমরা আমলে নিয়েছি। গ্রামীণফোনের ‘নিশ্চিন্ত’ প্যাকেজটিকে বলা হয়েছে সবার জন্য আকর্ষণীয় ফ্ল্যাট রেট। এই প্যাকেজের আওতায় জিপি থেকে জিপি বা অন্য নম্বরেও ২১ পয়সা প্রতি ১০ সেকেন্ড। অর্থাৎ এক টাকা ২৬ পয়সা প্রতি মিনিট। এই প্যাকেজে কোনো এফএনএফ সুবিধা নেই। অন্য অপারেটরে কিছুটা কম খরচে কথা বলার সুযোগ হলেও একই অপারেটরে কথা বলার ক্ষেত্রে কলরেট কমছে না। এরপর আছে গ্রামীণফোনের ‘বন্ধু’ প্যাকেজ। এই প্যাকেজে এফএনএফ সুবিধা আছে। কিন্তু সে কারণে এতে এফএনএফের বাইরে কলরেট বেশি। এতে জিপি থেকে জিপি ২৭.৫ পয়সা প্রতি ১০ সেকেন্ড। অর্থাৎ এক টাকা ৬৫ পয়সা প্রতি মিনিট। জিপি থেকে অন্য অপারেটরেও এই একই রেট। ১৭টি এফএনএফ নম্বরে এক টাকার কমে কথা বলা যায়। গ্রামীণফোনের ডিজুস গ্রাহকরা আগে কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেতেন। এজন্য এই প্যাকেজটি এক সময় বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু এখন এই প্যাকেজের ব্যয়ও কম নয়। যদিও একে বলা হচ্ছে এক্সক্লুসিভ কমিউনিটি রেট। এতে জিপি থেকে জিপি ২৭.৫ পয়সা প্রতি ১০ সেকেন্ড। অর্থাৎ এক টাকা ৬৫ পয়সা প্রতি মিনিট। জিপি থেকে অন্য অপারেটরেও এই একই রেট। ১০টি এফএনএফ নম্বরে এক টাকার কমে কথা বলা যায়। গ্রামীণফোন তার ‘স্মাইল’ প্যাকেজকে আনন্দের আরও উপলক্ষ হিসেবে বর্ণনা করলেও এখানে কলরেট সবার চেয়ে বেশি। এতে জিপি থেকে জিপি ২৮ পয়সা প্রতি ১০ সেকেন্ড। অর্থাৎ এক টাকা ৬৮ পয়সা প্রতি মিনিট। জিপি থেকে অন্য অপারেটরেও এই একই রেট। মাত্র তিনটি এফএনএফ নম্বরে এক টাকার কমে কথা বলা যায়। এই হলো গ্রামীণফোনের কলরেট। ভ্যাট ব্যতিরেকে এক টাকা ২৬ পয়সা থেকে শুরু করে এক টাকা ৬৮ পয়সা। কোথাও নেই এফএনএফ, কোথাও কম, কোথাও এফএনএফ আছে, তাই কলরেট বেশি।
অথচ এর বিপরীতে দেখা যায়, অন্য অপারেটরগুলোর অপশন এবং সুযোগ বেশি, কলরেটও তুলনামূলক কম। রবির ‘নূর’ প্যাকেজে নুর-নুর কল রেট ৭ পয়সা প্রতি ১০ সেকেন্ড বা প্রতি মিনিট ৪২ পয়সা। এই কোম্পানির ‘হুটহাট চমক’ প্যাকেজে রবি-রবি ও এয়ারটেলে ১১ পয়সা প্রতি ১০ সেকেন্ড বা প্রতি মিনিট ৬৬ পয়সা। অন্য অপারেটরে এক টাকা ২৬ পয়সা প্রতি মিনিট। ‘নবান্ন ৩৭’ প্যাকেজে রবি-অন্যান্য অপারেটরেও এক টাকা ২৬ পয়সা প্রতি মিনিট। আর রবি-রবি ও এয়ারটেলে রাত ১০টা – সকাল ৮টা পর্যন্ত ৪৮ পয়সা প্রতি মিনিট। দেখা যাচ্ছে রবির কলরেট ৫২ পয়সা থেকে শুরু করে এক টাকা ২৬ পয়সা পর্যন্ত। শীর্ষ আরেক অপারেটর বাংলালিংকের ‘বাংলালিংক দেশ ১ সেকেন্ড পাল্স’ প্যাকেজ-এ দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা যে কোনো অপারেটরে ২.২ পয়সা প্রতি সেকেন্ড বা মিনিটে ১ টাকা ৩২ পয়সায় কথা বলা যায়। এতে সুবিধা হলো প্রতি সেকেন্ড পালস, ফলে যতটুকু কথা, বিলও হবে ততটুকু। ‘বাংলালিংক দেশ এক রেট দারুণ’ প্যাকেজে আছে যে কোনো অপারেটরে কলের ক্ষেত্রে ২০.৮৩ পয়সা প্রতি ১০ সেকেন্ড বা মিনিটে এক টাকা ২৫ পয়সা প্রতি মিনিটে কথা বলার সুবিধা। ‘বাংলালিংক দেশ হ্যালো’ প্যাকেজে বাংলালিংক থেকে বাংলালিংক এক টাকা ৩৮ পয়সা প্রতি মিনিট। আর অন্য অপারেটরে ৭২ পয়সা প্রতি মিনিট। এভাবে দেখা যায় কলরেটের সুযোগ সুবিধা, পিক-আওয়ার, অফ পিক-আওয়ার ভেদে রেট কমা-বাড়া, অন্য অপারেটরের ক্ষেত্রে কখনও কখনও কলরেট কমা- সব ক্ষেত্রেই গ্রামীণফোন সুবিধা দিচ্ছে কম, টাকা নিচ্ছে বেশি।
যেকোনো দিক থেকেই হিসাব করা হোক না কেন, দেশের ছয়টি মোবাইল ফোন অপারেটরদের মধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহকদেরই বেশি অর্থ গুণতে হয়। কয়েক কোটি প্রি-প্রেইড গ্রাহককে ১০ সেকেন্ড পালসের বিল পদ্ধতিতে আটকে রেখেছে কোম্পানিটি, বিপরীতে পোস্ট-পেইডের ক্ষেত্রে এক সেকেন্ড পালস। গ্রামীণফোনের প্রি-পেইড ও পোস্ট-পেইড গ্রাহকদের কোনো হিসাব কোম্পানির কর্মকর্তারা দিতে না চাইলেও এই শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর পোস্ট-পেইড গ্রাহকের সংখ্যা ২৫ লাখের বেশি নয়; যার অর্থ দাঁড়ায় গ্রামীণফোনের গ্রাহকদের ৯৫ শতাংশ প্রি-পেইড গ্রাহক। এই গ্রাহকরা বাড়তি অর্থ ব্যয় করছেন, কিন্তু দুর্ভোগও তাদের বেশি পোহাতে হচ্ছে। গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের সবচেয়ে বড় অভিযোগগুলোর একটি হলো বাজে নেটওয়ার্ক ও কলড্রপ। আস্থা-বিশ্বাসের কথা, এক নম্বর কোম্পানি হওয়ার কথা তারা বারবার বললেও কার্যত গ্রামাঞ্চলে কোম্পানিটির নেটওয়ার্কের অবস্থা বেহাল। সম্প্রতি শহরেও একই অবস্থা দাঁড়িয়েছে। কলড্রপ তো রূপ নিয়েছে চরম আকারে। তাও দু’একদিন নয়, সেই ২০১৩ সাল থেকেই এই অবস্থা। সম্প্রতি যেন এই হার আরও বেড়ে গেছে।
২০১৪ সালের অক্টোবরে গ্রাহক সংখ্যা পাঁচ কোটিতে পৌঁছানোর মাইলফলক উদযাপন করার সময় একটি বিশেষ ‘অফার’ চালুর ঘোষণা দেয় গ্রামীণফোন। গ্রামীণফোনের সিএমও অ্যালান বঙ্কে সে সময় বলেছিলেন, আমাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্কের ওপর সবাই যেন আস্থা রাখতে পারেন, সেজন্য আমাদের নেটওয়ার্কের আওতায় যেসব গ্রাহক ফোন কল ড্রপের সম্মুখীন হচ্ছেন, তাদের সেই ড্রপ হওয়া কলের জন্য ৬০ সেকেন্ড ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
গ্রামীণফোনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ১ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই ‘অফার’ গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্কের আওতায় সব কলের জন্য প্রযোজ্য। একজন গ্রাহক একদিনে সর্বোচ্চ ৩০০ সেকেন্ড বা পাঁচ মিনিট এই সুবিধা পাবেন। এজন্য কোনো নিবন্ধনের প্রয়োজন হবে না। ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলে গ্রামীণফোন একটি এসএমএস-এর মাধ্যমে তা গ্রাহককে জানাবে এবং পোস্টপেইড গ্রাহকরা মাসিক বিলের সঙ্গে ক্ষতিপূরণ পাবেন বলেও সে সময় জানানো হয়।
কিছুদিন বাদে গ্রাহকরা অভিযোগ তোলেন, ঘোষণা আসার পর ‘দুই-একবার’ ক্ষতিপূরণ পেলেও ওই সুবিধা বাতিল করার কোনো তথ্য গ্রামীণফোন তাদের জানায়নি। এ বিষয়ে তারা কোনো এসএমএস পাননি, পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেখেননি। যদিও কলড্রপের বিপরীতে মিনিট ফেরতের ঘোষণা তারা দিয়েছিল ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে। এরপর এ নিয়ে কোম্পানিটি একেবারেই নিশ্চুপ। সময়ের সঙ্গে গ্রাহক সংখ্যা বাড়লেও নেটওয়ার্কে যে পরিমাণ জোর দেওয়া প্রয়োজন তা তারা দিচ্ছে না। ফলে কলড্রপে ভোগান্তি বাড়ছেই। গ্রাহকরা অনেকেই মনে করেন, নেটওয়ার্কের ওপর চাপ বেড়ে যাওয়া যেমন কলড্রপের কারণ, তেমনি এর পেছনে আয় বাড়াতে অপারেটরদের চাতুরিও রয়েছে। শুধু চাতুরি করে কলড্রপ ঘটিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে তাই নয়, মাঝেমধ্যে ব্যালেন্সের টাকাও হাওয়া হয়ে যায় বলে বিভিন্ন সময় ভোক্তারা অভিযোগ তুলেছেন। আরও অভিযোগ আছে, অফারগুলো বানানো হয় স্বল্প সময়ের জন্য। আর প্রচারে বলা হয় সবচেয়ে সাশ্রয়ী অংশটির কথা, নিচে ছোট করে, চোখে দেখা যায় না, এমনভাবে লেখা থাকে শর্ত প্রযোজ্য। সাধারণ মানুষ সেই শর্তের খোঁজ নেয় না। ফলে তারা যা ভেবে অফার গ্রহণ করেন, বাস্তবে তা পান না, ক্ষতিগ্রস্ত হন। দুর্বোধ্য অঙ্কে খরচের হিসাবগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, মানুষ এর ফাঁক ফোকর ধরতে পারেন না।
গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে সাধারণ গ্রাহকদের আরেকটি বড় অভিযোগ হলো, প্রমোশোনাল কল ও এসএমএস। প্রায় সব অপারেটরের বিরুদ্ধেই গ্রাহকদের এই অভিযোগ আছে। গ্রামীণফোনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, দিনে প্রায় ১০টির মতো এসএমএস পেয়ে থাকেন একজন গ্রাহক। যা কেবল বিরক্তির উদ্রেকই ঘটায় না, মানুষকে রীতিমতো বিপদেও ফেলে। গুরুত্বপূর্ণ এসএমএস এলেও তাকে কোম্পানির এসএমএস মনে করে আর দেখা হয় না, পরে এজন্য ভোগান্তিতে পড়তে হয়। শুধু যে ইন্টারনেটের অফার, কলরেটের অফার সংক্রান্ত মেসেজ আসে, তা নয়। ফোনকোম্পানি ব্যবসাও করে এর মাধ্যমে। অথচ গ্রাহক এর দায় নেয়ার কথা নয়। হঠাৎ করেই মেসেজ আসে অমুক প্রতিষ্ঠানের অমুক সেবা নিন। অর্থের বিনিময়ে ফোন কোম্পানি এরকম মেসেজ পাঠায়। গ্রাহক যদিও এ কারণে ফোন কেনেনি তবুও তাকে এসব মেসেজ পড়তে হয়। তাছাড়া রাত-বিরেতে, কাজের সময় ফোন আসে, এসএমএস আসে। এতে ঘুম বা কাজে বিঘœ ঘটে। রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা, গৃহিণী জয়িতা জয়ী বলেন, ফোন সব সময় সাইলেন্ট করে রাখতে হয়। ভাইব্রেশনেও রাখা যায় না। কিছুক্ষণ পরপরই এসএমএস আসতে থাকে। মাঝেমধ্যে ফোন আসে। বাচ্চা ঘুমায়, শব্দ হলেই তার ঘুম ভেঙে যায়। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক ফোনই ধরতে পারি না। বিরক্তি এতই চরমে উঠেছিল যে, কোম্পানিকে ফোন করে অনুরোধ করেছিলাম, টাকা-পয়সার বিনিময়ে হলেও এই ফিচার বন্ধ করা যায় কিনা। একবার এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম, মায়ের অপারেশনে রক্তের জন্য সে অপেক্ষা করছিল। ফেসবুকে তার নম্বর দিয়ে অনেকেই রক্ত চেয়ে স্ট্যাটাস পোস্ট করে। ফোন হাতে নিয়ে সে বসে আছে, কেউ মেসেজ পাঠায় কিনা। এদিকে একের পর এক আসতে থাকে কোম্পানির প্রমোশোনাল এসএমএস। শেষে ক্ষুব্ধ-বিরক্ত হয়ে আছাড় মেরে ফোন ভেঙে ফেলে সে। এদিকে ওই নম্বরেই আসবে রক্ত জোগাড়ের খবর। তাই আবার তাকে তখন ফোন কিনতে বের হতে হয়। আমারও মাঝেমধ্যে মনে হয় ফোন ভেঙে ফেলি। এই জ্বালাতন আর সহ্য হয় না।
গ্রাহকদের সঙ্গে অনাচারেই গ্রামীণফোন থেমে যায়নি, রাষ্ট্রের সঙ্গে অনাচারেও তাদের নাম এসেছে বারবার। রাষ্ট্রীয় কর ফাঁকি, ভিওআইপিতে (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) জড়িত থাকা এবং সিম বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করা। সম্প্রতি দেশে আশ্রয় নিয়েছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ। এদের বড় একটি অংশকে ফোন ব্যবহার করতে দেখা যায়। দেশে আগে থেকেই আছে আরও তিন লাখ রোহিঙ্গা। এদের প্রায় অধিকাংশেরই ফোন আছে। যদিও জাতীয় পরিচয় ব্যতিরেকে বাংলাদেশিরা সিম কিনতে পারেন না, অথচ দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের কাছে সিম বিক্রি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ, সরকারের বিধিনিষেধ কিছুকেই তোয়াক্কা করেনি ফোন কোম্পানিগুলো। সিম বিক্রি করে গ্রাহক বাড়ানো এবং এর মধ্য দিয়ে মুনাফা করাটাকেই তারা প্রাধান্য দিয়েছে। গ্রামীণফোনের সিমই রোহিঙ্গাদের হাতে বেশি বলে জানা গেছে।
ভিওআইপি অর্থাৎ বিদেশ থেকে অবৈধ ভয়েস কল আসার পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করে অর্থ রোজগারেও গ্রামীণফোনের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে বহুবার। ২০০৭ সালে সেলফোন অপারেটরদের কললিস্ট পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এর অংশ হিসেবে ওই বছরের ৬-১৪ ডিসেম্বর গ্রামীণফোনের কার্যালয়ে অভিযান চালায় সংস্থাটি। এতে অবৈধ ভিওআইপির সঙ্গে সেলফোন অপারেটরটির জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে। এ দফায় গ্রামীণফোনকে ১৬৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ২০০৮ সালের শুরুর দিকে আবারো গ্রামীণফোনের কার্যালয়ে অভিযান চালায় বিটিআরসি। সেবারও ভিওআইপির যন্ত্রপাতি উদ্ধারের পর ২৫০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। অবৈধ ভিওআইপির অভিযোগে ২০০৭-০৮ সালে দুই দফায় গ্রামীণফোনকে ৪১৮ কোটি টাকা জরিমানা গুনতে হয়। নিয়মবহির্ভূত টেলিযোগাযোগসেবা দেয়ার অভিযোগে ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে গ্রামীণফোনের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (সিইও) ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলাও করে বিটিআরসি। তবে জরিমানার অর্থ পরিশোধ করে মামলা থেকে অব্যাহতি পান তারা।
অবৈধ ও অনুমোদনহীন টেলিযোগাযোগসেবা প্রদানের অভিযোগে গত বছরের নভেম্বরে ৩০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয় গ্রামীণফোনকে। গো ব্রডব্যান্ড নামে সেবার আওতায় সোনালী ব্যাংককে অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দেয়ার অভিযোগে গ্রামীণফোনকে এ জরিমানা করে বিটিআরসি। গ্রাহক প্রতারণার নানা অভিযোগও আছে দেশের সবচেয়ে বড় এ সেলফোন অপারেটরের বিরুদ্ধে। গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণার দায়ে প্রতিষ্ঠানটিকে এ বছরের শুরুতে জরিমানা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ইন্টারনেটসেবার বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহককে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়ায় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এসব বিষয় নিয়ে গ্রামীণফোনের উপমহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. হাসানের সঙ্গে কথা বলতে তার ইমেইলে সংশ্লিষ্ট প্রশ্নগুলো পাঠানো হয়েছে। গ্রাহকদের এসব অভিযোগ সম্পর্কে তাদের অবস্থান জানতে চেয়ে তাকে ইমেইল বার্তা দেয়া হলেও এখনও তিনি তার জবাব দেননি। তার বক্তব্য পাওয়া গেলে আসছে প্রতিবেদনে তা যুক্ত করে প্রকাশ করা হবে। তবে সাপ্তাহিক-এর বর্ষ ১০, সংখ্যা ১৬ তে ‘মোবাইল কোম্পানি : থ্রিজিতে প্রতারণা করেছে, ফোরজিতে কী করবে?’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তার মতামত জানতে চেয়ে যেসব প্রশ্ন ইমেইলে পাঠানো হয়েছিল, কিছুদিন আগে তিনি এর জবাব পাঠিয়েছেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মোবাইল ফোন ইন্টারনেটের স্পিড নিয়ে গ্রাহকদের নানা ধরনের অভিযোগ আমরা পাই। ঢাকার বাইরে নেটওয়ার্কের বেহাল দশা, প্রচুর কলড্রপ, অযাচিত এসএমএস, কলড্রপের টাকা ফেরত না পাওয়া, অব্যবহৃত ডাটা ফেরত না পাওয়া, উচ্চমূল্যের ইন্টারনেটসহ নানা অভিযোগ আছে ভোক্তাদের। এর মধ্যেই আসছে ফোরজি। থ্রিজির অভিজ্ঞতা থেকে আপনারা কী শিখলেন? ফোরজিতেও কী থ্রিজির মতো অভিজ্ঞতা হবে গ্রাহকদের? এসব নিয়ে কী ভাবছেন আপনারা? আগামীতে গ্রামীণফোন মানুষকে কি দেবে, তা জানতে চাই। জবাবে গ্রামীণফোনের উপমহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. হাসান লিখেছেন, ‘মোবাইল বা বেতার প্রযুক্তিতে সীমাবদ্ধতা বিশ্বের সব দেশেই আছে আর সে কারণেই নতুন নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তির জন্ম হচ্ছে। তাই মোবাইল প্রযুক্তি নিয়ে গ্রাহকদের সন্তুষ্টির পাশাপাশি কিছু সমস্যা থাকতে পারে। গ্রামীণফোন সবসময়ই গ্রাহকদের এসব সমস্যা গুরুত্বের সঙ্গে সমাধান করে আসছে। তবে স্পেকট্রাম ব্যবহারে প্রযুক্তি নিরপেক্ষতা দেয়া হলে সেবার মান আরো উন্নত হতে পারতো। ফোরজি সেবা নিয়ে এখনও কোন মন্তব্য করার সময় আসেনি বলে আমরা মনে করছি। তবে এর সাফল্যও নির্ভর করবে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সহায়ক নীতিমালা গ্রহণ করার ওপর।’
থ্রিজি-ফোরজি তথা ইন্টারনেট সেবা নিয়ে গ্রামীণফোনের তৎপরতা বিষয়ে তার এই বক্তব্য বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন নয়। এমনকি গ্রাহকদের অভিযোগগুলোও এই বক্তব্যে স্বীকৃতি পায়নি। এটা খুবই পরিষ্কার যে, সমস্যা স্বীকার করা না হলে তার সমাধান অসম্ভব। আগামীতে সাপ্তাহিক আবারও ইন্টারনেট ব্যবহারে গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা ও প্রতিক্রিয়া, গ্রামীণফোনের ইন্টারনেট অফার এবং অপরাপর বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।
[ভেরিফাইড প্রেসের কন্টেন্ট পার্টনার সাপ্তাহিক বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ধারার সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন। লেখা সম্পর্কিত আপনার যেকোনো মতামত আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারেন নিচের মন্তব্য বক্সে বা ভেরিফাইড প্রেসের ফেসবুক পাতায়।]
Leave a Reply