জাতিগত বৈষম্য। চলমান সংকট। অমীমাংসিত পথরেখা। ব্রিটিশদের অভিবাসনের নীতি নিয়েছিলো। পাকিস্তানে যেতে ইচ্ছুক থাকা সত্ত্বেও মিয়ানমার সরকার তা চায় নি। মুক্ত হতে পারে নি রোহিঙ্গারা।

কৃষিকাজের জন্য আরাকানের কম জনঅধ্যুষিত এলাকায় অভিবাসন করার নীতি নিয়েছিলো ব্রিটিশরা। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। এসময় আরাকান ও বাংলার মাঝে কোন আন্তর্জাতিক সীমারেখা ছিল না এবং এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাওয়ার ব্যাপারে কোন ধরণের বিধিনিষেধ ছিল না। তাছাড়া ব্রিটিশরা আরাকান দখলের পূর্বেকার সময় কালাদান নদীর উত্তর তীর পর্যন্ত চট্টগ্রামের দক্ষিণ সীমানা ছিল। তবে বাংলাদেশ এসময় বার্মার সাথে যুক্ত ছিল বলে কোন ঐতিহাসিক দালিলিক অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয় নি। উনবিংশ শতকে হাজার হাজার বাঙালি কাজের সন্ধানে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরাকানে গিয়ে বসতি গড়েছিল। এছাড়াও হাজার হাজার রাখাইন আরাকান থেকে বাংলায় এসেছিল বিভিন্ন কারণে।
১৭৮৪ সালে ব্রিটিশরা বার্মা দখল করে নেয়। এসময় বার্মার সাথে বাংলা ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলগুলোর যোগাযোগ তৈরি হয়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ সালে ব্রিটিশদের কাছ থকে জাপানিরা বার্মা দখল করে নেয়। এসময় বার্মা ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করে ও স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। ১৯৪৫ সালে জাপানিদের হাত থেকে ব্রহ্মদেশ মুক্ত করে ব্রিটিশরা। এই তিন বছরে কমপক্ষে বিশ হাজার রোহিঙ্গা পূর্ব বাংলায় চলে আসে। তাছাড়া রোহিঙ্গারা ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশদের সাহায্য করে বার্মা দখল করতে। এসময় ব্রিটিশরা তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যে রাখাইনে মুসলামানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করা হবে। তবে আরও অনেক প্রতিশ্রুতির মতোই এই প্রতিশ্রুতিও রাখে নি ব্রিটিশরা।
১৯৪৭ সালে রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ আরাকান রাজ্যকে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। এটা নিয়ে জিন্নাহর সঙ্গে যোগাযোগ করেন রোহিঙ্গা নেতারা। রোহিঙ্গারা একটি বড় সশস্ত্র গ্রুপও তৈরি করে এবং মংদু ও বুথিধাং এলাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে উদ্যোগ নেয় । অনেকে মনে করেন, রোহিঙ্গাদের এই উদ্যোগ ছিল আত্মঘাতী ও মিয়ানমারে বৈষম্যের শিকার হওয়ার পেছনে এটি একটি বড় একটি কারণ। মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সেই সময়কার রোহিঙ্গাদের উদ্যোগকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত করে এসেছে। বাংলাদেশে যেভাবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সরাসরি সহায়তা করার কারণে বিহারি উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী সাধারণ মানুষের ঘৃণার শিকার হয়েছে, রোহিঙ্গারা সরাসরি সহায়তা না করলেও মিয়ানমারে একইভাবে বিরূপতার শিকার।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে মিয়ানমার। মিয়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনের উদ্গাতা ও ত্রাতা ছিলেন অং সান যিনি বর্তমান ডি-ফ্যাক্টো সরকারের রাষ্ট্রীয় প্রধান উপদেষ্টা অং সান সু চি’র বাবা। তিনি ১৯৪৭ সালের ১৯ জুলাই আততায়ীর গুলিতে মারা যান । তিনি মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী। এই হত্যার ছয় মাস পর মিয়ানমারের সাথে ব্রিটিশরা স্বাধীনতা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।
১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর চারটি বহুদলীয় নির্বাচন দেখেছে সেখানকার মানুষ। কিন্তু অং সানের সাথে তিন উপজাতীয় অঞ্চলের হওয়া চুক্তি বাস্তবায়িত হয় নি। ফলশ্রুতিতে ১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী পরিচালিত সরকার প্রধান নি উইন ক্ষমতা দখল করার পর রোহিঙ্গাদের প্রতি এই রাষ্ট্রীয় বৈষম্য আরও প্রকট রূপ ধারণ করে। ১৯৭০ সালের পর থেকে সেনাবাহিনীতে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে নিয়োগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর আগে থেকে সরকারি চাকরিতে থাকা রোহিঙ্গারা ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হয়।
লেখা: হাসনাত আসিফ কুশল
সম্পাদনা: মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম
[[লেখা সম্পর্কিত আপনার যেকোনো মতামত আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারেন নিচের মন্তব্য বক্সে বা ভেরিফাইড প্রেসের ফেসবুক পাতায়।]]
Leave a Reply