ফেসবুকে প্রায়ই ঢাকায় হিজরাদের হাতে কেউ না কেউ লাঞ্চিত হয়েছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কেনো হয় এমনটা? কখনই বা এটিকে হ্যারাসমেন্ট হিসেবে ধরে নেওয়া যায়?

“সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট” বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? প্রশ্নের জবাবে যাবার আগে আজকে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা বলি…
সন্ধ্যার পরপর মিরপুর থেকে মোহাম্মদপুরে আসার সময় বাসে ধরলো দুইজন হিজরা। শেষের দিক থেকে তিন নম্বর সিটে ছিলাম। বাসে বেশ ভালো সংখ্যক মানুষ ছিলো। আন্সারক্যাম্প থেকে বাসে উঠেই দুইজন সোজা চলে এলো আমার সিটে। এসেই টাকা চেয়ে বসলো!
পকেটে বাস ভাড়া ছাড়া একটা পয়সাও নাই। ওদেরকে সেটা বলার পর মোটামুটি চাপাচাপি মার্কা অবস্থা! আমি বরাবরই তাদের প্রতি সহানুভুতি প্রদর্শন করি। এবারও তার ব্যতিক্রম করলাম না। বরং টাকা পয়সা না থাকায় ভাবলাম তারা কতোটা এক্সট্রিম পর্যায়ে যেতে পারে দেখি! মানুষজনতো কতো কথাই বলে। হিজরাদের দ্বারা হ্যারাস হয়, আরো কতো কী!
শুরুতে একজন পাশে বসে বেশ বাজে ইঙ্গিত দেওয়া শুরু করলো। তিনি “ধরতে” আগ্রহী। আমি সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললাম, “এসব করতে হয় না। বাসভর্তি মানুষজন কী বলবে?” সে বেশ জোড়াজুড়ির পর ব্যর্থ হয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা বাদ দিয়ে সহজ কথাবার্তা শুরু করলো। যদিও তার সেই স্বাভাবিক গল্পের ভাষাও এখানে লেখা সম্ভব না।
মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে এটা জেনে গেলাম যে সে আগে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে থাকতো। এখন থাকে কল্যাণপুর শহীদ মিনার রোডে। একটা নতুন তথ্য পেলাম। আমরা সবাই জানি হিজরাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়। আজ শুনলাম সাধারণ মানুষ তাদেরকে দিয়ে হ্যান্ড-জব সহ বিভিন্নরকম কাজ(!) করিয়ে নেয়। বিনিময়ে অর্থ দেয়। তাই তার মধ্যে এমন একটা ধারণা ঢুকে গিয়েছে যে চান্স পেলে সবাই’ই টাকার বিনিময়ে এসব করাবে। আমি যখন না বললাম তখন বললো, “বিয়ার পর বউয়ের লগেতো সবই করবি। আমগোরে ভাল্লাগে না?”
গল্প করতে করতে সে হাতের আঙ্গুল ফুটায়ে দিলো। হাত পা টিপে দিলো। তারপর নামার সময় কথা নাই বার্তা নাই গালে একটা চুমো দিয়ে চলে গেলো! যাবার আগে বলে গেলো, “তুই একটা ভালো মানুষ রে। তোর কথা শুনেই বুঝতে পারছি। আমরা যাদেরকে ধরি তাদেরকে ছাড়ি না। তোরে ছাইড়া দিলাম। তুই যেনো একটা সুন্দরী বউ পাস।” বাস থেকে নামার আগে রীতিমতন হেল্পারকে শাসায়ে গেলো, “ওর কাছ থেকে কোনো ভাড়া নিবি না!” আমি হাসি মুখে বিদায় দিয়ে কানে হেডফোন লাগায়ে গান শুনতে থাকলাম।
হ্যারাসমেন্টের সজ্ঞায় ফিরে যাই। বাসভর্তি মানুষজন সবাই দেখেছে কী হয়েছে। আমি নিজে যে বিব্রত হই নি সেটা বললে ভুল বলা হবে। কারণ, আমি নিজে সবসময় তাদের পক্ষে কথা বলি। শুধুমাত্র হিজরা না, পুরো এলজিবিটি কম্যুনিটির প্রতি আমার একটা সফট কর্ণার কাজ করে। কারণটা সহজ, তারা কেউ নিজের ইচ্ছায় এমনটা হয় নি। সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে ওভাবে করেই সৃষ্টি করেছে। আর আমি যদি হ্যারাসড না হই, আমি যদি নিজে থেকে অ্যাবিউজড ফিল না করি তাহলে কার বাপের সাধ্য আছে যে আমাকে সেক্সুয়ালি হ্যারাস করবে?
আমরা সবসময় মুদ্রার একটা পিঠ দেখে বিচার করতে চাই। আমরা দেখি যে ওরা রাস্তাঘাটে মানুষজনের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে। আমরা দেখি যে ওরা মানুষজনের হাত ধরায় তারা এমন লাফ দেয় যেনো হাতে তেলাপোকা বা মাকড়সা পড়েছে! কেনো? ওদেরকে আপনি ভয় পাবেন কেনো? আপনার ভয়টাকে পুঁজি করেই ওরা আপনার কাছ থেকে টাকা নিতে পারে। আমি বলছি না যে টাকা দেবেন না। আমি বলতে চাচ্ছি যে টাকা দিন, কিন্তু ভয়ের কারণে না। টাকা দিন যাতে তারা দুটো খেয়ে-পড়ে বাঁচতে পারে সেজন্যে। ওদেরকে সাহায্য করুন যাতে ওদের বাড়তি অর্থের জন্যে কারো কাছে গিয়ে অ্যাবিউজড হতে না হয়।
সরকার যখন তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তখন আমরা সেই দায়িত্ব নিজেদের ঘাড়ে তুলে নেই। বন্যা কবলিত এলাকায় লাখ লাখ টাকার ত্রান পাঠাই আমরা সাধারণ মানুষরাই। হিজরারা আমাদের দেশে শুরু থেকেই অবহেলিত। তাদেরকে কেউ কাজ দেয় না। কাজ কী দেবে? তাদের স্পর্শ পাওয়া মানে জাহান্নাম নিশ্চিত, এমন ধারণা পর্যন্ত কাজ করে অনেকের মধ্যে! অথচ আমরা একটাবার চিন্তা করি না যে ওরাও মানুষ। আর পাঁচজন মানুষের যেসকল চাহিদা আছে ওদেরও তা আছে। ক্ষুধার জ্বালা ওদেরও সহ্য করতে হয়। একমাত্র পার্থক্য হলো, আপনার ক্ষুধার জ্বালা নিবারণের জন্যে আপনি কাজ করতে পারেন। ওরা সেটা পারে না। কেউ কাজ দেয় না ওদেরকে। আপনি সমাজের একটি অংশ। ওদেরকে সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। আর এ কারণেই তাদেরকে বেছে নিতে হচ্ছে উপার্জনের অবৈধ পথ। ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে রাস্তাঘাটে মানুষকে ভয় দেখিয়ে টাকা নিতে হচ্ছে।
সরকারের কাছে চিল্লাচিল্লিতো অনেক হলো, কাজের কাজ কিছুই হলো না। এবার কি আমরা নিজেরাই পারি না ওদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে? ওদেরকে কাজকর্ম দিয়ে সমাজের ভেতর নিয়ে আসতে? দৃষ্টিভঙ্গি বদলেই শুরুটা করি! সেটা করতেতো আর পয়সা লাগবে না…
ছবি: এএফপি
[লেখা সম্পর্কিত যেকোনো মতামত আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারেন নিচের মন্তব্য বক্সের মাধ্যমে।]
Leave a Reply